শিরোনাম
রায়হান উল্লাহ
প্রকাশ: ১১:৪৮, ১১ মে ২০২৫ | আপডেট: ১১:৫১, ১১ মে ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
যদিও নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিকভাবে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল ইসি। পরে এনসিপিসহ কিছু দলের আবেদনের প্রেক্ষিতে সময় আরো দুই মাস বাড়িয়ে ২২ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন দেখার পালা এই সময়ে নিবন্ধন পেতে আবেদন করে কিনা এনসিপি।
অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন এনসিপি সংশ্লিষ্টরা। তাদের বক্তব্য- সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত নিবন্ধনের আবেদন করবে না দলটি।
জানা যায়, গত ১৭ এপ্রিল ইসিতে দল নিবন্ধনের সময়সীমা তিন মাস বাড়ানোর আবেদন করে এনসিপি। দলের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে এই আবেদন জানান এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন ও তাজনূভা জাবীন এবং সদস্য মনিরুজ্জামান।
এনসিপির আবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনসংক্রান্ত বর্তমান প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকেই বিগত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও তার আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন ভোটবিহীন সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা, জাল ভোট, রাতের ভোটসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করেছে। একইভাবে শেখ হাসিনা ও তার দলীয় নির্দেশনা অনুযায়ী ওই কমিশন সারা দেশে দলীয় প্রতীকে বিতর্কিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও আয়োজন করেছিল। বিদ্যমান আইনি কাঠামোর মধ্যেই ইসির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার সারা দেশে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস ও ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ছাত্র-জনতা বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন।
এনসিপি বলেছে, ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় গণমানুষের প্রত্যাশার আলোকে এনসিপি প্রতিষ্ঠিত হয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করে। এর মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন একটি প্রতিবেদনসহ তাদের সুপারিশ কর্তৃপক্ষের কাছে দিলেও এখন পর্যন্ত মৌলিক সংস্কার কার্যক্রমের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। নির্বাচন কমিশনের মৌলিক সংস্কার এবং বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী না করেই বর্তমান ইসি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য গত ১০ মার্চ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সংস্কারের আগেই ত্বরিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে সমালোচনার জন্ম দেয়।
২০০৮ সালের রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা ও প্রাসঙ্গিক আইনের অধীনে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্তগুলোকে ‘সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অসাংবিধানিক’ বলে আখ্যা দিয়ে এনসিপির আবেদনে বলা হয়েছে, আগের স্বৈরাচারী সরকারের আমলে তৈরি এই বিধিগুলো রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে সংকুচিত এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য প্রণীত। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নিজেই জেলা পর্যায়ে ১০ শতাংশ ও উপজেলা পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ কার্যালয় স্থাপনের শর্ত সহজীকরণের পাশাপাশি প্রতি পাঁচ বছরে নিবন্ধিত দলের নিবন্ধন নবায়নের বাধ্যবাধকতার প্রস্তাব দিয়েছেন। তা ছাড়া ইসির বর্তমান কাঠামো ও ব্যক্তিদের নিয়োগ ২০২২ সালের বিতর্কিত আইন অনুসারে গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব ও নিরপেক্ষতা রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে, যা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করছে।
চিঠির শেষাংশে এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন বা সংশোধন করে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হওয়া দরকার। এ ছাড়া মৌলিক সংস্কারের আলোকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, বিদ্যমান নিবন্ধিত দলের নিবন্ধন হালনাগাদ করাও আবশ্যক। এমন অবস্থায় দ্রুত নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত মৌলিক সংস্কার এবং নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদনের সময়সীমা অন্যূন ৯০ দিনের বাড়ানোর অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপি হয়তো দল গোছানোর জন্য আরেকটু সময় নিচ্ছে। তাদের দৃষ্টি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি হবে না তাতেও ছিল। সব মিলিয়ে দলটি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং একইসঙ্গে নিবন্ধন পেতে পুরোপুরি প্রস্তুত হচ্ছে।
এনসিপি সংশ্লিষ্ট অনেকে জানান, নির্বাচন কমিশন সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত নিবন্ধনের আবেদন করবে না এনসিপি। যেহেতু সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান এবং সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই প্রোক্লেমেশন ঘোষণা করা হবে, এরপরই নির্বাচন প্রক্রিয়ার দিকে যাবে এনসিপি।
এনসিপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জুলাই প্রোক্লেমেশনের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে এনসিপির শীর্ষ নেতারা। তাদের চাওয়া এর মাধ্যমে গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। এজন্য সংস্কার ও জুলাই প্রোক্লেমেশন বাস্তবায়ন চাহিদার শীর্ষে রয়েছে।
এনসিপির যুগ্ম-আহ্বায়ক ড. আতিক মুজাহিদ বলেন, ইসি নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য একটি ডেডলাইন দিয়েছিল। আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশন সংস্কার হওয়ার দরকার। এ জন্য সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সংস্কার হতে হবে।
তিনি বলেন, বিদ্যমান আইনে আমরা চাইলেই নিবন্ধনের শর্ত-পূরণ করতে পারবো। কিন্তু আমরা আবেদন করবো না। নির্বাচন কমিশন সংস্কার হলেই নিবন্ধনের জন্য আবেদন করবো।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে এটির সংস্কার করতে হবে। আমরা মনে করছি নির্বাচন কমিশন সংস্কারের আগেই নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কার্যক্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না করার দুরভিসন্ধি হতে পারে।
বিদ্যমান আইনে এনসিপি দল হিসেবে নিবন্ধনের শর্তপূরণ করতে পারবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের বর্তমান যে আইন আছে সেই আইনের সবগুলো শর্ত আমরা পূরণ করতে পারবো।
এনসিপির এ নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। এ অপরাধে আওয়ামী লীগের বিচার হতে হবে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, জুলাই প্রোক্লেমেশন এখনো ঘোষণা করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন সংস্কারসহ যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে তারা সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এখন ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংস্কার করতে হবে। তারপর নির্বাচন কমিশন একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। এরপরই নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হবে। এমনটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিজেদের মতো করে নিবন্ধনের তারিখ ঘোষণা করেছে।
ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য সময় বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২২ জুন পর্যন্ত নতুন দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা যাবে। তিনি বলেন, ২০টি নতুন দল বিভিন্ন মেয়াদে সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে। আর সাতটি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫৪টি। সর্বশেষ ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করা হয়। আইন অনুযায়ী, নিবন্ধন পাওয়ার শর্তগুলোর মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কার্যালয় এবং অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন (মহানগর) থানায় কার্যালয় থাকতে হবে এবং প্রতিটি কার্যালয়ে ন্যূনতম ২০০ ভোটার তালিকাভুক্ত থাকার শর্ত রয়েছে।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ