শিরোনাম
রিপন ইসলাম শেখ, নীলফামারী
প্রকাশ: ১৫:৫৬, ৩ জুলাই ২০২৫
ভারতীয় চোরাচালান ও নেশাদ্রব্য পারাপারের মূল ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে তিস্তা ব্যারাজ । ছবি: সংগৃহীত
পরিবেশ রক্ষার্থে যেখানে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হলো তিস্তা সেচ প্রকল্প, সেখানে কেপিআই এলাকার ১ হাজার মিটারের আশেপাশে কোনো ভারী যন্ত্র বা মেশিন দিয়ে পাথর, বালু বা অন্য কোনো খনিজ পদার্থ উত্তোলন করা নিষেধ।
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, সেই পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও একটি কুচক্রীমহলের নির্দেশে। কেপিআই এলাকায় ব্যবহার করা হচ্ছে ইঞ্জিন চালিত বোমা মেশিন। ক্যানেলের বালু উত্তোলন করে নদীর ভূগর্ভ ভরাট করছে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
বালু উত্তোলনের স্থান থেকে প্রায় ২০০ মিটার পশ্চিমে পরিদর্শন বাংলো, উত্তর-পূর্বে তিস্তা ব্যারাজ নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও তিস্তা ব্যারাজ অবস্থিত। ইতোমধ্যেই বালু উত্তোলনের জায়গাগুলোতে তৈরি হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ ফুট গভীরতা। অন্যদিকে উত্তোলিত বালু তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে ফেলা হচ্ছে, যা নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণে সেচ নালার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং প্রকল্পের কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ভারতীয় চোরাচালান ও নেশাদ্রব্য পারাপারের মূল ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে তিস্তা ব্যারাজ। বিগত বছরগুলোতে র্যাব নীলফামারী-১৩ সিপিআই-২ এর অভিযানে ব্যারাজ এলাকা থেকে ৩-৪ হাজার বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছে। এছাড়াও রয়েছে ইয়াবা, গাজাঁ, এলএসডি ও কোডিন। হাতিবান্ধা থানার তিস্তা ফাঁড়ি ১ বছরে প্রায় ২০টি মাদকের চালান আটক করে। এছাড়াও প্রতিনিয়ত পারাপার হয়ে আসছে ভারতীয় চোরাই বাই সাইকেল ও অন্যান্য পণ্য। পুলিশ, আনসার ব্যাটালিয়ন ও শতাধিক সিসি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যারাজে কিভাবে মাদকদ্রব্য ও চোরাই পণ্য আসছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দোয়ানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এরশাদুল হক ট্রাক থেকে লেনদেনের বিষয়ে অস্বীকার করলেও, মাদক ও চোরাচালানের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি এড়িয়ে যান। হাতিবান্ধা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহমুদ উন নবী অভিযানে মাদক আটকের কথা বললেও, অন্যপথ থাকার পরেও এই পথে কেন, এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
সাদ্দাম হোসেনসহ একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, তিস্তা ব্যারাজ এলাকা বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবনকারীর নিরাপদ রুট হিসেবে পরিণত হয়েছে। সরকার তিস্তা ব্যারাজের পাহারাদার (আনসার) ও সিসি ক্যামেরা মেরামত করলে রাতের অন্ধকারেও ব্যারাজ এলাকায় কি হচ্ছে, তা পরিষ্কার হতে পারবে।
বোর্ডের জমি দখল ও পুকুর 'লীগের' সম্পত্তি: তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও নদী শাসনের জন্য ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। নিয়মিত সরকারের রাজস্ব খাতে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে আসলেও বেশির ভাগ জমি দখলে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রভাবশালীদের কাছে। ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানী হাট-বাজারে একরামুল হক চৌধুরী ও সাবেক জাতীয় পার্টির নেতা মরহুম আব্দুল লতিফ চেয়ারম্যান ২৫০টি দোকান ঘর নির্মাণের মাধ্যমে ১০ একর জমি দখল নিয়েছেন। শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডের পতিত জমি নয়, সেচ নালাও দখল করে নির্মাণ করেছেন বহুতল ভবন। দখল করে গড়ে উঠেছে চাপানী হাট-বাজার ও ডালিয়া নতুন বাজার নামে একটি বাজার।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসর কটেজের পাশের পুকুরটি বন্দোবস্তো ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে লোকমান হোসেন নামের এক ব্যক্তি ভোগ করে আসছেন। জানা গেছে, লোকমান হোসেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী মোতাহার হোসেনের ছেলে সোহাগ ও সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান শ্যামল এর ব্যবসায়ী পার্টনার। তার সিন্ডিকেটে পুকুর দখল, টেন্ডার বাণিজ্য, ব্যারাজ দিয়ে ভারী গাড়ি পারাপার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আনিছুর রহমানসহ অনেকে দাবি করেন, ব্যারাজটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এর সঠিক ব্যবহার হলে তারা সুখে শান্তিতে থাকতে পারবেন এবং পরিবেশ সুন্দর হলে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকরা আসবে। ব্যারাজে যখন গাড়ি উন্মুক্ত চলাচল করতো, এখানে দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীরাও আসতো। ব্যারাজের প্রবেশদ্বারে দুটি চেকপোস্টে গাড়ি (মালগাড়ী) ওজনের জন্য স্কেল স্থাপন করা থাকলেও পাঁচ বছরেও কোনো কাজে আসেনি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিয়মিত সকাল বিকেল ৩০-৪০ মেট্রিক টন মালবাহী ট্রাক চলাচল করছে। বেশির ভাগেই পরিবহণ আসে পাটগ্রাম, বুড়িমারী স্থলবন্দর থেকে পাথর, কয়লা, বালুসহ অন্যান্য মালামাল। প্রতিদিন ৩০০-৪০০টি মালবাহী ট্রাক পারাপার করে।
তারা জানান, এই গাড়ি পারাপারে যে টাকা আসে, তা ব্যারাজে থাকা পুলিশ, আনসার, দালাল অফিস ও ব্যারাজের দায়িত্বরত লোকজন, রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয়।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, তিস্তায় বর্তমানে যে প্রবাহমান রয়েছে এতেই প্রতি বছর বন্যায় প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ব্যারাজ আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ, তার যদি সঠিক ব্যবহার না হয়, অনিয়মিত ভাবে ব্যবহারের ফলে নষ্ট হয় চলাফেরা যেমন অসুবিধা হয়, তেমনি ব্যারাজের ভাটিতে অর্থাৎ লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামও প্রভাব পড়বে।
টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পওর) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ব্যারাজ দিয়ে ভারী গাড়ি চলাচলের কোনো সুযোগ নেই এবং ক্যানেলের নিষ্কাষণ খাল সংস্কারের জন্য ৩৫টি প্যাকেজে কাজ চলমান রয়েছে, এরমধ্যে ১০টি প্যাকেজ সম্পন্ন হয়েছে। অবসরের পিছনে যে পুকুর আছে, সেটি বর্তমানে তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে লিজের আওতায় নিয়ে আসা হবে। বিভিন্ন জায়গায় জমি দখল থাকলে সেগুলো উদ্ধারের জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছেন এবং বাজেট প্রাপ্তি সাপেক্ষে উচ্ছেদ অভিযান চালাবেন। দুটি সেচ খাল বিলীন হয়ে গেছে কিনা, তা তার জানা নেই বলে জানিয়েছেন।
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এসএ