ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

১০ আষাঢ় ১৪৩২, ২৭ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

রাঙালো শেরপুরের দৌড়বিদ

চায়নার গ্রেট ওয়ালে বাংলাদেশের পতাকা

ক্রীড়া প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রকাশ: ১৫:৫৮, ১০ মে ২০২৫

চায়নার গ্রেট ওয়ালে বাংলাদেশের পতাকা

চায়নার গ্রেট ওয়ালে বাংলাদেশের পতাকা রাঙালো শেরপুরের দৌড়বিদ ইঞ্জিনিয়ার আল আমিন সেলিম। প্রথম বারের মতো দুই জন বাংলাদেশি গ্রেট ওয়াল চায়না ম্যারাথন সম্পূর্ণ করেছেন। এই ম্যারাথন পৃথিবীর কঠিনতম ম্যারাথনগুলোর একটি। সদ্য হয়ে যাওয়া গ্রেট ওয়াল চায়না ম্যারাথন ৪২.১৯৫ (ফুল ট্রেইল ম্যারাথন) সফলভাবে শেষ করেছেন। অতিরিক্ত উচ্চতা (২০০০ মিটার) হওয়ায় গ্রেট ওয়াল চায়না ম্যারাথন সবসময় চ্যালেঞ্জিং এবং কঠিনতম পথ অতিক্রম করতে হয়, অক্সিজেন স্বল্পতাই অতিরিক্ত নোস ব্লিডিং, ব্রিথিং ইস্যুস, এয়ার প্রেসার, এবং আর্দ্রতা জনিত অনেক চ্যালেঞ্জিং এর সম্মুখীন হতে হয় রানারদের।

আল আমিন সেলিম পেশায় একজন বস্ত্র প্রকৌশলী, একটি চাইনিজ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কান্ট্রি ম্যানেজার। তিনি তার কর্মস্থলের পরিচয়ের চেয়ে একজন ক্রীড়াবিদ হিসাবে পরিচয় দিতেই বেশি ভালবাসেন। গড়ে তোলেছেন শেরপুর রানার্স কমিউনিটি এবং উত্তরা ফ্যালকন ক্লাব। রানিং এর পাশাপাশি ক্রিকেট কেও ধারণ করেন অন্তরে। নিয়মিত খেলার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলাও আয়োজন করে যাচ্ছেন, তাছাড়া শেরপুরের অনেকগুলো ইভেন্টের পৃষ্ঠপোষকও তিনি।  

তিনি বলেন, ‘আমরা খেলা বলতে শুধু ক্রিকেট/ফুটবল কেই বুঝি, এই দুই খেলার বাহিরেও যে অনেক ভাবে বাংলাদেশ কে প্রতিনিধিত্ব করা যায় পাশাপাশি নিজেকে সুস্থ রাখা যায় সেই জায়গাগুলো নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। হতে পারে সাতার, দৌড়, সাইক্লিং,হাইকিং, স্কেটিং, বক্সিং এর মতো খেলাধুলাগুলো।’

এখন পর্যন্ত আল আমিন ব্যাংকক ম্যারাথন, টাটা কলকাতা ২৫ হাজার, কোস্টাল আলট্রা (৫০ কি: মি:) শমশেরনগর আলট্রা (৫০ কি:মি:), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথন সহ অসংখ্য দেশ বিদেশের ইভেন্ট সফলভাবে শেষ করছেন। নিজ জেলাকে প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছেন  বাংলাদেশের প্রতিটি কমিউনিটিতে। 

শেরপুরে আল আমিনের হাত ধরেই ‘শেরপুর ১০ কি: মি: রান’  ইভেন্ট আয়োজন হয়েছিল ২০২৩ সালে। যেখানে ৫৫০ দৌড়বিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে পরিসমাপ্তি হয়েছিল। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে ‘শেরপুর হাফ ম্যারাথন” প্রস্তুতি নিচ্ছেন, শেরপুরকে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে সকলের সহযোগিতা কামনা করছেন।

আল আমিন আরও বলেন, ‘সুস্থতা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার বড় নিয়ামত, সুস্থ থাকতে চাইলে নিয়মিত শরীরচর্চার বিকল্প নেই, পাশাপাশি খাদ্যাভাস ও অত্যন্ত জরুরি। শরিচর্চা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস একটি আরেকটির পরিপূরক, একটি কে রেখে আরেকটি সম্ভব নয়। সুস্থ দেহ মানেই সুস্থ মন আর সুস্থ চিন্তা। সুস্থ চিন্তা দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নেবো।’

এই যাত্রা নিয়ে আল আমিন সেলিম ফেসবুকে একটি পোস্টও দিয়েছেন। পোস্টটি হুবহু পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

গ্রেট ওয়াল ম্যারাথন, কি রোমাঞ্চকর ব্যপার তাইনা। ভাবলাম রথ দেখার পাশাপাশি কলাও বেচে আসি (যেহেতু আমি একটি চাইনিজ বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলি, আমি ৪২.১৯৫ আর আমার বন্ধু মনির ১০ কি: মি: ক্যাটাগরি তে। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় আমাকে একাই যেতে হয়। লম্বা পথ জার্নি করে ৩০ তারিখ পৌঁছে কিট কালেক্ট করি। ইভেন্ট অর্গানাইজার আমাদের জন্য একদিনের ফ্রি হোটেল ব্যবস্থা করেছিলেন বেইজিং মারকিউর হোটেলে। ১ তারিখ সকাল ৫টা ৩০ মিনিটে আমরা (২৪০ জন রানার, ম্যাক্সিমাম চায়নার বাহিরের রানার) রওনা হয়ে যাই স্বপ্নের গ্রেট ওয়ালের উদ্দেশ্যে। বেইজিং সিটি থেকে প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। আমার ৭:৩০ টায় পৌঁছে যাই। ইভেন্ট গ্রাউন্ডে যখন দেখি ৪৩ টি দেশের পতাকা (ফ্ল্যাগ) হিমেল হওয়ায় দুল খাচ্ছে, বিশ্বাস করুন বাংলাদেশের পতাকা দেখে কি যে একটা অনুভূতি অভির্ভূত হয়েছিলো সেটা প্রকাশ করা অসম্ভব। এটি একটি অন্যরকম অনুভূতি।বেসিক ব্রেকফাস্ট, ওয়ার্ম আপ এবং রেস ডিরেক্টর সাহেবের পরিপূর্ণ ব্রিফিং শেষে আমরা সকাল ৮ টায় রান শুরু করি। রান শুরুর সময় বুঝতেই পারিনি কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।১ কি: মি: ফ্ল্যাট রাস্তার পর দেখা পেলাম গ্রেট ওয়ালে উঠে যাবার পাহাড়, শুরু করলাম আল্লাহর নাম নিয়ে, কোনও ভাবেই শেষ হতে চায় না সেই পাহাড়, এক্সাক্টলি ৩৮ মিনিট পর দেখা পেলাম সেই পৃথিবীর স্বপ্নের সপ্তম আর্চার্য গ্রেট ওয়ালের। একটি  ল্যাডার(মই) দিয়ে উঠতে হবে, দেখেই ভয় পেলাম বাট ‘শো মাস্ট গো অন’ আমাদের গ্রেট ওয়ালের ২ টা সাইড কভার করতে হবে, নর্থ এবং সাউথ পার্ট। প্রথমে নর্থ পার্টের পালা, এই পার্ট অনেক বেশি সরু আর ভাঙা ছিলো পৃথিবীর যত বড় অ্যাথলেট হউক না কেনো ভয় পেতে হবেই। জানিয়ে রাখি গ্রেট ওয়ালে অনেক বেশি হিমেল বাতাস বহমান থাকে, মাঝে মধ্যে মনে হবে আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমার কাছে আমাদের কালবৈশাখী ঝড়ের বাতাসের মতো মনে হয়েছে কিছুটা। এই বাতাস মোকাবেলা করে মুভ করে এবড়া থেবরা রাস্তা ধরে উঠা নামা করা একপ্রকার জটিল ব্যপার। নর্থ পার্ট শেষ না হতেই আবিষ্কার করি ডান পায়ের কাপ মাসল ক্র্যাম্প। একটু পর অনুভব করলাম নাক দিয়ে টপটপ করে কি যেনো গড়িয়ে পড়ছে, প্রথমে ভাবলাম হয়তো ঠান্ডায় নাক দিয়ে পানি পড়ছে, যখন হাত নিলাম অনেক বেশি ভয় পেয়ে গেলাম, আমার নাক দিয়ে জীবনে কখনও ব্লিডিং হয়নি। একদিকে মাসেল ক্র্যাম্প আর অন্য দিকে নোস ব্লিডিং। আমি মনে মনে চিন্তা করে ফেলি যে ‘গিভ আপ উড বি বেটার চয়েজ দ্যান অ্যানি মেজর ইস্যু’। প্রথম ৬ কি: মি: ফিনিশ করতে অলমোস্ট ১ ঘন্টা ৪৮ মিনিট সময় লেগে যায়। নর্থ পার্ট শেষ করে রেস অর্গানাইযার কে বলি কোনভাবে ফুল ম্যারাথন থেকে হাফ ম্যারাথনে কনভার্ট করা যাবে কি না ! উনি ইগনোরে করে দেন পাশাপাশি বেশ কিছু টিপস প্রধান করেন যা পরবর্তী তে একপ্রকার রসত হিসাবে কাজ করেছে।পাশাপাশি বলেন বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম পার্টিসিপেট করেছো, কিছু একটা অর্জন করে নিয়ে যাও দেশের জন্য। বিশ্বাস করুন এই একটি কথা সব সম্ভব করে দিয়েছেন। ম্যাসেজ আর ক্র্যাম্প রিলিজ স্প্রে করে আবার রওনা দেই, আল্লাহ কে বলি, আল্লাহ এটলিস্ট তুমি শেষ করার তৌফিক দাও, যেনো একটি ফিনিশিং মেডেল এই আসরে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে পারি, এই লাল সবুজের পতাকার মান টা রাখার তৌফিক দাও। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ১৩০০০ ফিট উচ্চতা থাকায় নোস ব্লিডিং টা আর ঠেকাতে পারি নি, নোস ব্লিডিং, ব্রিথিং ইস্যুজ আর হ্যামস্ট্রিং পেইন নিয়েই ৮ ঘণ্টা ৫২ মিনিট ৫২ সেকেন্ড সময় নিয়ে ২৩০০ মিটার এলিভেশন গেইন করে ফিনিশ লাইনে পৌঁছে যাই। ফিনিশ লাইনে তাদের রানার ফিনিশিং সেলিব্রেশন, মেংজিয়ালা মেংজিয়ালা (বাংলাদেশের চাইনিজ নাম) বলে বলে চিল্লানো আমার আজীবন মনে থাকবে। এটি আমার জীবনের শ্রেষ্ট অর্জন, ফিনিশিং মেডেল নিয়ে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ রেইস করার মতো গর্বের আর কি হতে পারে। এই ধরনের ব্রুটাল (কঠিন) রেসগুলো তে পার্টিসিপেট করতে হলে লম্বা সময় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করার কোনও বিকল্প নেই। পাশাপাশি প্রপার ট্রেইল ট্রেনিং, গাইডলাইন, ফুড ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত জরুরি। চায়নাতে ভ্রমণে বেশ কিছু বিষয় মাথায় নিয়ে মুভ অন করা অত্যন্ত জরুরি,

১. ল্যাঙ্গুয়েজ : ম্যাক্সিমাম চাইনিজ মানুষ তাদের চাইনিজ(হাংঝ) ভাষায় কথা বলেন, ইংলিশ একদম বুঝেন না। এখানে আপনাকে অনেক বেশি ভুগতে হবে।

২. ডলার এক্সচেঞ্জ: এক্সচেঞ্জ বুথ নেই বললেই চলে, আপনাকে উনাদের ব্যাংক থেকে এক্সচেঞ্জ করতে হবে। সাথে করে আরএমবি (চাইনিজ ইউয়েন) নিয়ে যাওয়া ভালো।

৩. ফুড: ফুড ম্যানু সিলেকশন এ আপনাকে অনেক সমস্যায় পরতে হবে, কারন ভাষা জনিত কারণে আপনি বোঝাতেই পারবেন না। তাদের ম্যাক্সিমাম খাবারই পর্ক (শুকুরের মাংস) দিয়ে বানানো।

৪. প্রতারক ট্যাক্সি ড্রাইভার: এখানেও অনেক প্রতারক ট্যাক্সি ড্রাইভার পাবেন, অসাবধানতায় বিপদ হতে পারে।

৫. খরচে শহর: বেইজিং এবং বেশ কিছু মেজর সিটি অনেক বেশি এক্সপেন্সিভ, কোন বন্ধের সময় চায়না ভ্রমণ না করাই ভালো। 

আমার এই ভ্রমণের সকল শুভাকাঙ্খীদের অনেক ধন্যবাদ। আমাকে আপনাদের দুয়ায় আর ভালোবাসার রাখবেন।

আরও পড়ুন