শিরোনাম
মীর রাকিব হাসান
প্রকাশ: ১৬:৩৮, ২৯ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৬:৫৬, ২৯ মে ২০২৫
ব্যারিস্টার মাসুদ আলম
মাসুদ আলম নিজের গ্রামের মাদ্রাসার মেঝেতে বসে স্বপ্ন দেখতেন—একদিন এই দরিদ্র জীবন পেরিয়ে পৃথিবীর বড় বড় মঞ্চে কথা বলবেন। আজ তিনি নিউজিল্যান্ড হাইকোর্টের অভিজাত বার-এ একজন সিনিয়র ব্যারিস্টার ও মানবাধিকারকর্মী। মাসুদ আলমের জন্ম লক্ষ্মীপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে, এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে। বাবা মওলানা রহমতুল্লাহ ছিলেন একজন ইবতেদায়ী শিক্ষক। দত্তপাড়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করেন, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হন। ২০০৭ সালে মাসুদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই বাবা মারা যান। পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি দিনরাত টিউশনি করে পরিবার ও খরচ চালাতেন। মাদ্রাসা শিক্ষায় বেড়ে ওঠা এই তরুণ অল্প সময়েই ইংরেজিতে হয়ে ওঠেন দক্ষ, যা ছিল তাঁর আন্তর্জাতিক যাত্রার প্রথম ধাপ।
ছাত্রজীবনে মাসুদের দিন শুরু হতো ভোরে ফজরের নামাজের পর। ঢাকার রমনা পার্কে তিনি শুরু করেন আইইএলটিএস কোচিং। এই কোচিং থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই মাত্র এক বছরে লন্ডনের টিকিট কাটেন। ২০০৯ সালে তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে—নতুন অধ্যায়ের শুরু সেখান থেকেই।
লন্ডনে গিয়ে শুরু হয় এক নতুন যুদ্ধ। দিনে কয়েক জায়গায় কাজ করে রাতে ক্লাসে যেতেন। বাসের ভাড়াও সাশ্রয় করে বই কিনতেন। যুক্তরাজ্যে থেকে মাসুদ এলএলবি অনার্স, পিজিডি এবং মাস্টার্স করেন। এরপর নিউজিল্যান্ডে পাড়ি দেন—এক স্বপ্নের নতুন গন্তব্যে। অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অর্জন করেন জিডিএল এবং সিওপি ডিগ্রি। শুরু করেন আইনপেশা। আইন পেশায় তাঁর উৎকর্ষের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২৪ সালে তিনি নিউজিল্যান্ডে ‘সিনিয়র ব্যারিস্টার ও সলিসিটর’ হিসেবে মনোনীত হন—যা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ছিল এক বিশাল গৌরবের মুহূর্ত।
মাসুদ তাঁর পেশার পাশাপাশি হয়ে উঠেছেন অভিবাসীদের কণ্ঠস্বর। নিউজিল্যান্ডে শোষিত অভিবাসীর অধিকার আদায়ে তিনি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে সরকার ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করেন। তিনি নিউজিল্যান্ড সরকারের কাছে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি উত্থাপন করেন: বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা, বিনামূল্যে খাবার, এক বছরের ওপেন ওয়ার্ক ভিসা, এবং অভিবাসীদের শোষণকারী অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা। তাঁর নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডে প্রকাশিত আর্টিকেল এই দাবিগুলোকে বিশ্বের দৃষ্টিগোচর করে। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে সরকার ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাঁর দাবি মেনে নেয়—অভিবাসীদের জন্য বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা, খাবার, এবং ওপেন ওয়ার্ক ভিসা প্রদান করে। এই অভূতপূর্ব সাফল্য মাসুদ আলমকে নিউজিল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশিদের কাছে অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। শত শত অভিবাসী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই অবদান বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়। নিউজিল্যান্ডের হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত আর্টিকেল এবং ওয়ান টিভি-রেডিওর সাক্ষাৎকারে তিনি অভিবাসীদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হন। তাঁর কণ্ঠ বিশ্বের কাছে এক নতুন আলোর বার্তা বয়ে আনে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে তিনি ফিরে যান সেই মাদ্রাসায়, যেখানে একদিন কেরোসিন বাতির আলোয় পড়তেন। শিক্ষকরা আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মাসুদ নিজেও থেমে যান শ্রদ্ধায়, স্মৃতির ভারে কাঁপতে থাকে তাঁর কণ্ঠ। এক শিক্ষক তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তুই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছিস মাসুদ… তোকে দেখে মনে হয়, আমাদের শিক্ষা বৃথা যায়নি।’ মাদ্রাসার এক কোনায় বসে আবেগাপ্লূত হয়ে মাসুদ বলেন, ‘এই মাটিই আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে কষ্টের সঙ্গে লড়তে হয়। দারিদ্র্য, পারিবারিক দায়িত্ব, বা সামাজিক বাধা কোনোকিছুই আমার স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। মেধা, পরিশ্রম, আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে বিশ্বজয় সম্ভব।’
তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে লড়াই, আত্মত্যাগ ও অধ্যবসায়ের গল্প। তিনি বারবার বলেন— ‘স্বপ্ন দেখো, কিন্তু ঘুমিয়ে নয়। জেগে থেকে, কষ্ট করে, চেষ্টা করে স্বপ্ন পূরণ করতে হয়।’ তাঁর এই গল্প বাংলাদেশের লাখো তরুণকে শুধু অনুপ্রাণিত করে না, বরং জীবনের দিক নির্দেশনাও দেয়।
ব্যারিস্টার মাসুদ আলম এখন শুধুই একটি নাম নয়—তিনি হয়ে উঠেছেন স্বপ্নপূরণের এক প্রতীক। তাঁর গল্প প্রমাণ করে দেয়, দারিদ্র্য কখনো মেধার জোর থামিয়ে দিতে পারে না, প্রতিকূলতা কখনো সংকল্পকে পরাজিত করতে পারে না। এই যুগে যখন হতাশা অনেকের নিত্যসঙ্গী, তখন মাসুদের গল্প একটি দীপ্ত আলোকবর্তিকা, যা দেখায়— “বাংলাদেশি তরুণদের পক্ষে বিশ্বজয়ও সম্ভব।”
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ