শিরোনাম
ড. মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন
প্রকাশ: ১৬:২৭, ২ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ১৬:৩৩, ২ জুলাই ২০২৫
বায়ু দূষণে শহর ঢাকা প্রায়শই সেরা হচ্ছে । ছবি: সংগৃহীত
সমগ্র বিশ্বে যখন টেকসই উন্নয়নের পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ার দুই গুরুত্বপূর্ণ শহর দিল্লি ও ঢাকা, অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবেশ দূষণের শীর্ষ তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে । প্রশ্ন উঠছে, দিল্লি না ঢাকা-কে বেশি পরিবেশ দূষণে সংকটে? ঢাকা ও দিল্লি উভয় শহরই বায়ুদূষণের "রেস টু দ্য বটম"-এ শীর্ষে থাকলেও তাদের সংকটের ধরন ও প্রভাব আলাদা । ঢাকায় গড় AQI ১৮০-২৫০ (শীতকালে ৩০০+), যার প্রধান উৎস যানবাহন (৫৮%) ও ইটভাটা (১৫%), এবং PM2.5 কণার কারণে বছরের ৮০% সময় স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে, যেখানে দিল্লিতে AQI ২০০-৩৫০ (শীতকালে ৫০০+) এবং কৃষি অগ্নিকাণ্ড (৪০%) ও যানবাহন (৩০%) দূষণের মূল কারণ, সঙ্গে ভয়াবহ NO2 মাত্রা । ঢাকায় প্রতি বছর ৩০,০০০+ মৃত্যু হয় বায়ুদূষণে, বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীদের শ্বাসকষ্ট বাড়ায়, অন্যদিকে দিল্লিতে প্রতি ৩ জনে ১ জন ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত এবং আয়ু গড়ে ১২ বছর কমেছে । ঢাকার দূষণ সারা বছর স্থায়ী হলেও দিল্লিতে শীতকালে পাঞ্জাব-হরিয়ানার খড় পোড়ানোর কারণে তা তীব্রতর হয় ।
গত ১৬ জুন ২০২৫ প্রকাশিত, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (EIU) এর রিপোর্ট অনুযায়ী গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্সে (https://www.eiu.com/n/campaigns/global-liveability-index-2025/), ঢাকা ১৭৩টি শহরের মধ্যে ১৭১তম স্থানে রয়েছে, যা গত বছর (২০২৪ ) ১৬৮তম এবং তার আগের বছর (২০২৩) ১৬৬তম ছিল । এই ধারাবাহিক পতন রাজধানীর নগর ব্যবস্থাপনার দীর্ঘদিনের সমস্যাকে তুলে ধরে। ধারাবাহিকভাবে, এই পতন আমাদেরকে আতংকিত করে এবং রাজধানীর নগর ব্যবস্থাপনার দীর্ঘদিনের সমস্যাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে । বিপরীতে, ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন এ বছর সূচকের শীর্ষস্থান দখল করেছে এবং ভিয়েনার তিন বছরের শীর্ষ রাজত্বের অবসান ঘটিয়েছে; কোপেনহেগেন স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো ও শিক্ষায় ১০০ এবং স্বাস্থ্যসেবা ও সংস্কৃতি ও পরিবেশে যথাক্রমে ৯৫.৮ ও ৯৫.৪ স্কোর পেয়ে মোট ৯৮.০ পয়েন্ট শীর্ষস্থান অর্জন করেছে । পশ্চিম ইউরোপীয় শহরগুলো সূচকের শীর্ষে আধিপত্য বজায় রাখলেও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সংঘাতপীড়িত অঞ্চলগুলোর শহরগুলো নিম্নস্তরে অবস্থান করছে। গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্স বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর জীবনমান মূল্যায়নের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড । এবারের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (EIU) রিপোর্টে, ভারতের অবস্থান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা না হলেও, হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে ১৭৩টি শহরের মধ্যে দিল্লি এবং মুম্বাই যথাক্রমে ১২০তম এবং ১২১তম স্থানে রয়েছে ।
১. আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দুর্বলতা: বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু আইন ও নীতিমালা থাকলেও, সেগুলোর বাস্তবায়ন প্রায়শই অকার্যকর । অবৈধ শিল্পকারখানা, নদী দখল, বন উজাড়, এবং অনিয়ন্ত্রিত দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না । আদালতের রায় ও নীতিগত সুপারিশ থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নে জটিলতা রয়েছে ।
২. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের আধিপত্য: পরিবেশ সুরক্ষার চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রায়শই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় । বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো নির্মাণ, এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে পরিবেশগত প্রভাব উপেক্ষা করা হয় । পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ এবং নীতিগত সুপারিশ অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ও কর্পোরেট চাপের মুখে পড়ে গুরুত্ব হারায় ।
৩. অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়ন: ঢাকা ও অন্যান্য প্রধান শহরে অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দূষণ ক্রমেই বাড়ছে । নির্মাণকাজে ধুলাবালি ও রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
৪. জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব: বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার প্রকোপ বাড়ায় পরিবেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ।
৫. জনসচেতনতার অভাব: অনেক সময় নাগরিকেরা নিজেরাও না জেনে বা সচেতনতার অভাবে পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে ওঠেন। যেমন, যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা, বাতাসে ধুলাবালি ছড়ানো, প্লাস্টিক পোড়ানো, কিংবা অপ্রয়োজনে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার পরিবেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে থাকে ।
বায়ুদূষণ রোধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন, এবং এ লক্ষ্যে সরকার, নগর প্রশাসন ও সচেতন নাগরিকদের সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য । নিয়মিত বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর দূষণ নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব যানবাহন চালু এবং গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা জরুরি, যাতে ব্যক্তিগত যানবাহনের ওপর নির্ভরতা কমে আসে এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন কোনোভাবেই সড়কে চলাচল করতে না পারে । অপরিকল্পিত নগরায়ন রোধ করে শিল্প-কারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে, এবং এসব শিল্প-কারখানাকে শহরের বাইরে স্থানান্তর করতে হবে, যেন নগরীর পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে। কৃষি জমি ও জলাশয় ভরাট বন্ধ করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা দরকার, কারণ এগুলোর অস্তিত্বই শহরের দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশগত স্বাস্থ্যের অন্যতম উপাদান । পাশাপাশি শহরকে বাসযোগ্য রাখতে ব্যাপকভাবে সবুজায়ন বাড়ানো এবং গাছ লাগানোর টেকসই কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত । এছাড়া নির্মাণকাজের সময় ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, যেন নগরবাসী অন্তত একটুখানি বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারে । এ প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম বা মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তারা তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট, অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন, পরিবেশবান্ধব জীবনের প্রচার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সংলাপ তৈরিতে সহায়ক হতে পারে ।
সমাধানের ক্ষেত্রে, ঢাকাকে গ্রিন ট্রান্সপোর্ট ও শিল্পনীতি বাস্তবায়ন না করলে স্থায়ী বিপর্যয় আসন্ন, অন্যদিকে দিল্লি যদি খড় পোড়ানো ও শীতকালীন দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে তবে দ্রুত উন্নতি সম্ভব । উভয় শহরই জরুরি ভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন । গ্রিন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ও ক্লিন এনার্জি ব্যবহার জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, কারণ ঢাকা ও দিল্লির মতো শহরগুলোর বায়ুদূষণের জন্য যানবাহনের ধোঁয়া (৫৮%) এবং জ্বালানি নির্ভর শিল্পকারখানা (২৫%) দায়ী । উদাহরণস্বরূপ, চীনের শেনঝেন শহরে ১০০% ইলেকট্রিক বাস চালু করে বায়ুদূষণ ৩৫% কমিয়েছে ।
মাননীয় পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করে আসছেন । সে জন্য তার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ছিলো অনেক । বাংলাদেশের মানুষ আশাবাদী ছিলেন যে তার প্রচেষ্টায় পরিবেশের দৃশ্যমান উন্নতি হবে । কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি চোখে পড়ছে না । শুধু ঢাকার পরিবেশ নয়, সারা দেশে কিছু কুচক্রী মহল অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করেছে, জলাশয়-কৃষি জমি অবাধে ভরাট করছে, পাহাড় কাটছে, বন উজাড় করছে, ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে । এ ব্যাপারেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না । বিশেষ করে, আমার এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে মেঘনা নদী থেকে প্রতিদিন অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে, ফলে মানিকনগর বাজার থেকে বড়িকান্দি পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকার বসতবাড়ি, ফসলি জমি, কবরস্থান নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে । এই ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এবং অপ্রয়োজনীয় বালি উত্তোলন বন্ধ করে অনতিবিলম্বে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি । প্রকৃতপক্ষে, সারা বাংলাদেশে একই চিত্র, প্রতিদিন খবরের কাগজে নিউজ আসছে, এই অবৈধ বালুর ব্যবসা নিয়ে খুন-খারাবিও হচ্ছে সারা দেশে । প্রশাসনকে এই বিষয়ে অত্যন্ত অত্যন্ত কঠোর ও সচেতন হতে হবে এবং অবিলম্বে পরিবেশের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় এমন যেকোনো ধরনের তৎপরতা বন্ধ করতে হবে ।
রাজধানীর চারপাশে নির্মাণকাজ, অপরিকল্পিত শিল্প কারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া ও অন্যান্য দূষণকারীর কারণে বাতাসের মান ক্রমশ খারাপ হচ্ছে । ঢাকার বায়ুদূষণের এই চিত্র উদ্বেগজনক । বায়ুদূষণের ফলে মানুষের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে । বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্তদের জন্য এই দূষণ মারাত্মক হয়ে উঠছে । শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগ এমনকি দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলছে বায়ুদূষণ । পরিশেষে বলতে চাই, দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে বায়ুদূষণ নিয়ে প্রতিযোগিতা নয়, বরং সমাধানের পথে এগোনো দরকার । দুই শহরের জন্যই দূষণ কমানো এখন সময়ের দাবি । কারণ, পরিবেশের সংকট দিল্লি বা ঢাকার একক সমস্যা নয়, এটি সবার সম্মিলিত দুর্যোগ । একে মোকাবিলা করতে হলে সীমান্তের গণ্ডি পেরিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা, টেকসই উন্নয়ন ও সচেতন নেতৃত্ব প্রয়োজন । পরিবেশ রক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই টেকসই উন্নয়নের মূল চেতনা, যা এই শহরগুলোর ক্ষেত্রে কার্যত অনুপস্থিত । টেকসই উন্নয়ন বলতে বোঝায় এমন এক উন্নয়ন প্রক্রিয়া যা বর্তমানের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনের সুযোগ কোনোভাবেই নষ্ট না হয় । তা না হলে আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই উন্নয়ন ও বসবাসযোগ্য একটি পৃথিবী রেখে যেতে পারব না ।
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এসএ