শিরোনাম
মেহেদী হাসান রনি
প্রকাশ: ১৩:০৫, ১৫ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৩:৩৮, ১৫ জুন ২০২৫
প্রতীকী ছবি
একজন আদর্শবান বাবার মস্তিষ্কেই তার সন্তান অনুভব করতে শিখে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই সম-অধিকারে বেঁচে থাকার প্রাপ্যতা আছে, অনুরূপভাবে একজন আদর্শবান বাবার কানেই তার সন্তান শুনতে শিখে তার চারপাশের সৎ এবং সত্য মানুষগুলোর তৃপ্তির হাসি; অপরদিকে অসততা ও মিথ্যা পুষিত জীবনের আহাজারি। বাবার শরীর দিয়েই একটি সন্তান অনুভব করতে শিখে যে এই পৃথিবীটা বেঁচে থাকার তাগিদে কতটা শ্রম আর কতটা ঘাম ঝরাতে হয়।
একজন পুরুষ এবং একটি বাবার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে তাদের দায়িত্বভারের, একজন বাবা শুধু তার নিজের স্বপ্নের বাহক নন তাকে পরম মমতা এবং যত্নের সঙ্গে লালন করতে হয় পরিবারের প্রতিটি স্বপ্নকে। সন্তানের কাছে বিশ্বাস এর আরেক নাম হচ্ছে বাবা; যার হাত ধরে পৃথিবীর সকল দুর্গম পথেই পা রাখা যায় অতি আস্থার সঙ্গে। প্রতিটি সন্তানের কাছেই তার বাবাই হচ্ছে সবচেয়ে সাহসী মানুষ যে কিনা তাদের প্রতিটি চাওয়াকেই ছিনিয়ে আনতে পারে। বাবা হচ্ছে সন্তানের কাছে আয়নার মতো যেখানে প্রতিফলিত হয় তার আদর্শ, বিবেক ও ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। ছোটবেলা থেকেই একটি সন্তানের চোখে বাবা যে রঙিন স্বপ্নের পৃথিবী এঁকে দেয় তার বাস্তবায়নেই বাবাদের জীবনে শত চেষ্টা। বিসর্জনের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে নিজের সকল স্বাদ, আহ্লাদ শুধুমাত্র সন্তানের স্বপ্ন চাওয়াকে আলিঙ্গন করেই যে তৃপ্তি সুখের হাসি তা শুধু বাবাদের মুখেই মানায়। জীবন সংগ্রামের এক অকুতোভয় সৈনিক সে, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা কিংবা দুর্ব্যবহার জীবন-জীবিকা চক্করে ঘটে চলেছে হরহামেশাই তবু সব ভুলে দিনশেষে মুচকি হেসে সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরতে শুধু বাবারাই পারে। আদর্শ আর শাসনের বুননে তৈরিকৃত যে চাদরে একজন বাবা তার সন্তানকে জড়িয়ে রাখে তা একটি সন্তানের কাছে ক্ষণিকের ভালো না লাগার অনুভূতি হলেও জীবনের দীর্ঘ পথ চলায় একসময় ঠিকই উপলব্ধি চলে আসে যে কতটুকু ভালোবাসার আবির মিশ্রিত ছিল সেই অনুশাসন।
বাবার সঙ্গে সন্তানের ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বের গভীরতা অঙ্কনের প্রয়াসেই একটি বাস্তব জীবনের গল্প তুলে ধরলাম- গ্রামের একটি ছিমসাম ছোট এবং সুখী পরিবার, সংসারে সদস্য বলতে মাত্র তিনজন, বাবা-মা আর একমাত্র ছেলে সন্তান। বাবা একজন সরকারি ব্যাংকার ছিলেন; যিনি বেশ কিছুদিন আগেই অবসর নিয়েছেন। একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবা এবং ছেলে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসায় ছিল না ভাগ। মাঝে মাঝে মনে হত প্রকৃতির আপন পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হওয়া এই বাবা এবং ছেলের বন্ধুত্ব। তা দেখে অনেকের মাঝে এক ধরনের হিংসেও কাজ করতো। কারণ ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব এই দুইয়ের প্রতি মানুষের লোভ অসীম। ছেলের শৈশব থেকে শুরু করে বাবা কখনোই তার নাম ধরে ডাকেনি, বাবা ও ছেলেকে বাবা বলেই ডাকতো, ছেলের প্রতি বাবার যে শাসন সেখানেও ছিল না উচ্চস্বর কিংবা চোখ রাঙানো। বাবার দেখানো পথের শিখানো ভাষায় ছেলে বড় হতে থাকে, ছেলে বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার চিন্তা চাহিদাগুলি বড় হতে থাকে, অপরদিকে বাবার নিবেদিত সামর্থ্য ছেলেকে কখনোই অপূর্ণতার স্বাদ গ্রহণ করতে দেয়নি। ছেলেকে ঘিরেই বাবার স্বপ্নের পৃথিবী, কল্পনার পাতায় পাতায় একে রেখেছে শতশত সুখের আল্পনা। যেমন ছেলে ভালো রেজাল্ট করবে, ভালো একটি চাকরি করবে, আরো হয়তো অনেক অব্যক্ত অনুভূতি।
ছেলেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাড়ি জমাতে হবে শহরে, কিন্তু বাবার আবেগি হৃদয় বাস্তবতা গ্রহণ করতে পারলেও অন্তরের চাপা কান্না তো থেমে থাকার নয়। নিজের অজান্তেই চোখের কোনায় এক ফোটা জল চলে আসে। তারপরও জীবন-যুদ্ধের বাস্তবতায় নিজের শত অনিচ্ছাগুলোকে লুকিয়ে রেখে হলেও বাবা বাধ্য হয় ছেলেকে শহরে পাঠাতে, যে ছেলের মুখ না দেখে হয়তো সে কখনো অফিসে যায়নি, একটি দিনও কাটেনি বাবার যে ছেলের সঙ্গে অন্তত একবেলা হলেও একসঙ্গে খাওয়া হয়নি। শহরের বুকে ছোট্ট একটি মেসে থাকা, অচেনা পরিবেশ, অপরিচিত সব বন্ধুদের সাথে মেলামেশা, চারপাশের সমাজে ঘটে যাওয়া নানান অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সবমিলিয়ে বাবার মনের মাঝে এক দুশ্চিন্তার পাহাড় , এভাবেই কাটতে থাকে অগণিত নির্ঘুম রাত্রি, তারপরও ছেলের ওপর বাবার অগাধ বিশ্বাস, সে মানুষের মত মানুষ হবে, বড় একটি চাকরি করবে, সব মিলিয়ে একটিই চাওয়া জীবনের শেষ বেলায় যেন তার কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে পারে, কিন্তু সে কখনো চাইনি তার ইচ্ছাপূরণের বাড়তি বোঝা তার ছেলেকে বহন করতে হোক।
একবার ভাবুন তো ভালবাসার গভীরতা কতটা থাকলে একটি মানুষ এইভাবে চিন্তা করতে পারে, একটি বাবার পক্ষেই শুধু এটা অনুভব করা সম্ভব। একসময় ছেলেটি তার পড়ালেখা শেষ করে এবং ছোট একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে যোগদান করে, বাবার চোখ তখন খুশির জলে ছলছল, সে কাকে রেখে কাকে জানাবে এই খুশির খবর সেই আনন্দে দিশেহারা, ছেলের সাফল্যে বাবার বুকটা তখন গর্বে ভরে ওঠে। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে জীবন-সংগ্রামের দিনগুলো, এক সময় বাবার পছন্দেই অনেক ধুমধাম করে বিয়ে করে ছেলেটি, তাদেরো কোলজুড়ে চলে আসে তৃতীয় প্রজন্মের কর্ণধার। ছেলে, বৌমা ও নাতিকে নিয়ে বাবা যেন খুঁজে পায় এক স্বর্গ সুখের স্বাদ। কিন্তু আলো-আঁধারের ন্যয় মানুষের জীবনেও সুখ-দুঃখগুলো যে চিরস্থায়ী নয় তা এই বাবার জীবনের গল্পেই প্রমাণিত। চাকরি থেকে একটি দিন ছুটি পেলেই ছেলেটি ছুটে আসত তার বাবাকে এবং নবজাতক ছেলেকে দেখতে,পৃথিবীর কোনো দুর্যোগই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এই ছুটে আসার পথে, দেড় বছরের ছেলেটি কেবলমাত্র মুখ ফুটে একটু বাবা ডাক শিখেছে, কিযে সুমধুর এই আধো আধো কণ্ঠের ডাক, পৃথিবীর সমস্ত শব্দগুলোই যেন মূল্যহীন এই একটি শব্দের কাছে, এটি শুধু একটি বাবাই অনুভব করতে পারে।
প্রতিবারের মতো এবারো ছুটি কাটিয়ে খুব সকালেই ছেলেটি তার মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হয়েছে তার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। যথারীতি পরিবারের সবাই তাকে বিদায় জানানোর জন্য গ্রামের মেঠোপথ ধরে কিছু দূর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে, হাসিমাখা মুখগুলোকে বিদায় দিতে খুবই কষ্ট হয় ছেলেটার তারপরও কিছু করার নেই, জীবন-জীবিকার চক্রে আবদ্ধ আমাদের বাবাদের জীবন, সেখানে আবেগের স্থানটা অত্যন্ত ক্ষীণ। ছেলেটি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই থানা থেকে একটি ফোন আসে যে মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্টে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই সে মৃত্যুবরণ করে। ছেলেটির বাবা তখনো জানে না এই নির্মম পরিস্থিতির কথা, পুরো গ্রামে চলে আসে এক শোকের ছায়া, গ্রামবাসী কারোর পক্ষেই এই খবরটি তার বাবার কানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এটি শুধু একটি ছেলের মৃত্যু নয়, একটি বাবার জমিয়ে রাখা শত সহস্ত্র স্বপ্নের মৃত্যু, ছেলেকে ছাড়া বাবার কাছে জীবনটা আজ শুধু একটি বর্ণহীন পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকা, বাবার শারীরিক মৃত্যু না হলেও তার অন্তর আজ মৃত। কত উৎসব কত ঈদ চলে যায় ছেলে আর বাড়ি ফিরে আসে না, হয়তো বাবা ডাকটিও তার অনেকদিন ধরে শোনা হয় না। এখন সে তার নাতির মাঝেই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে তার হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে, কারণ বাবাদের ভালোবাসা অমর।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ