ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৮ মুহররম ১৪৪৭

মাহফুজ আলম মনে করিয়ে দিলেন সেসব বিরল নেতাদের

সোহেল অটল

প্রকাশ: ২০:৩৫, ১৬ মে ২০২৫ | আপডেট: ১২:৩২, ১৭ মে ২০২৫

মাহফুজ আলম মনে করিয়ে দিলেন সেসব বিরল নেতাদের

শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হুসাইনের সঙ্গে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম । ছবি: সংগৃহীত

উসমানী সাম্রাজ্যের এক মহান শাসক ছিলেন। নাম- সুলতান আবদুল হামিদ দ্বিতীয়। তাঁর সময়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটত প্রায়শই। একবার এক ব্যক্তি তাকে হত্যা চেষ্টাকালে ধরা পড়ে। এই অবস্থায় যেকোনো শাসক সহজেই মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন।
কিন্তু সুলতান আবদুল হামিদ তাকে হত্যা না করে নিজ প্রাসাদে এনে কথা বলেন। তাকে খাবার দেন এবং পরে ক্ষমা করে দেন।

উসমানী সাম্রাজ্যের মহানুভবতা নিয়ে আলোচনার যে বিষয়গুলো আছে, এটা তার মধ্যে অন্যতম। ঘটনাটি একদিকে যেমন তাঁর মহানুভবতা প্রকাশ করে, অন্যদিকে ইসলামী নীতিবোধ ও সহনশীল শাসনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়।

ইতিহাসে এমন বিরল কিছু ঘটনা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। বিশেষ করে এমন মুহূর্ত, যখন কেউ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে প্রতিশোধের পরিবর্তে ক্ষমা ও মানবিকতা বেছে নেয়। রাজনীতি, ক্ষমতা বা শাসন ব্যবস্থায় এমন উদাহরণ খুব বেশি দেখা যায় না। কিন্তু কখনো কখনো এমন ঘটনা ঘটে, যা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়—ক্ষমতা মানে শুধু নিয়ন্ত্রণ নয়, ক্ষমতা মানে দয়া দেখানোর সাহসও।

সেই সাহস খুব অল্প কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দেখাতে পেরেছেন। যারা পেরেছেন, তাদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা অন্যতম। এই বিশ্বনন্দিত নেতা ২৭ বছর কারাবাস ভোগ করেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য। মুক্তির পর তিনি যখন দেশের প্রেসিডেন্ট হন, তখন তাঁর সামনে সুযোগ ছিল—অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার। কিন্তু তিনি সেই পথে হাঁটেননি।

তিনি ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন গঠন করেন, যেখানে অপরাধীরা তাদের অপরাধ স্বীকার করলে ক্ষমা পেত। এমনকি তাঁর কারারক্ষী, যারা তাকে শারীরিক অত্যাচার করেছিল, তাদের সাথেও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখেন। এই দৃষ্টান্ত বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়, ক্ষমা কিভাবে একটি জাতিকে পরিবর্তনের পথে নিতে পারে।

ভারতীয় নেতাদের মধ্যে মাহাত্মা গান্ধীর মধ্যেও ছিল অহিংসার চূড়ান্ত রূপ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা মহাত্মা গান্ধী ছিলেন অহিংসার প্রতীক। তিনি হত্যার উদ্দেশ্যে অনেকবার হামলার শিকার হয়েছেন। একবার এক হামলাকারী তাঁকে আঘাত করতে এলে গান্ধী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি, বরং শান্তভাবে তার সঙ্গে কথা বলেন।

গান্ধীর আদর্শ ছিল, ‘প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে নয়, প্রেম ও সহানুভূতির মাধ্যমে অন্যায়কে জয় করা।’

ইসলামী ইতিহাসে ক্ষমার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন। তিনি যখন মক্কা বিজয় করেন, তখন তার শত্রুরা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কারণ তারা ভেবেছিল প্রতিশোধ নেওয়া হবে। কিন্তু রাসুল (সা.) ঘোষণা করেন, ‘আজ তোমাদের কোনো ভর্ৎসনা নেই। আমি তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম।’

এই বক্তব্য শুধু একটি ঘোষণাই ছিল না, বরং বিশ্ব ইতিহাসে ক্ষমার শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হয়ে আছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন ক্ষমার দৃষ্টান্ত নেই। নেই বলা একেবারে ভুল হবে। অতি সম্প্রতি একটা দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। তা করেছেন আমাদের তরুন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।

দুদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সময় তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী পানির বোতল ছুঁড়ে মারেন। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, সেই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংষ্কৃতিতে ক্ষমা বলে কোনো শব্দ নেই। আর এমন কাণ্ড ঘটানোর পর তো ক্ষমা করার মতো সাহসও দেখাতে পারেনি কেউ।

কিন্তু এর বিপরীতে মাহফুজ আলম সেই শিক্ষার্থীকে ক্ষমা করেন। শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হুসাইনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার অভিভাবকদের হাতে সোপর্দ করেছে ডিবি। ডিবি অফিসে থাককালীন হুসাইন এবং তার পরিবারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। আন্দোলন শেষে হুসাইনকে বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।

সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে, এর আগে দুপুরে তথ্য উপদেষ্টা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ জানান, যাতে হুসাইনকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। একজন মানুষ যখন ক্ষমতার শীর্ষে থাকেন, তখন প্রতিশোধ নেওয়া তার পক্ষে সবচেয়ে সহজ কাজ। কিন্তু ইতিহাস স্মরণ রাখে সেই মানুষদের, যারা প্রতিশোধ নয়, বরং ক্ষমা ও ভালোবাসার শক্তিতে জয়ী হয়েছেন।

আক্রমণ করতে আসা কাউকে ক্ষমা করা এবং বাসায় দাওয়াত দেওয়া নিছক মানবিকতা নয়—এটি এক ধরনের সাহস, উদারতা এবং মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত রূপ।

সোহেল অটল: নির্বাহী সম্পাদক, ঢাকা এক্সপ্রেস

atol.bd@gmail.com

ঢাকা এক্সপ্রেস/ আরইউ

আরও পড়ুন