ঢাকা, সোমবার, ০২ জুন ২০২৫

১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৫ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

শিরোনাম

মানবিক করিডোর: বাংলাদেশের মানবতা, নিরাপত্তা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

শীমুল চৌধুরী

প্রকাশ: ২০:৫৬, ২১ মে ২০২৫ | আপডেট: ০৮:২০, ২২ মে ২০২৫

মানবিক করিডোর: বাংলাদেশের মানবতা, নিরাপত্তা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’র মধ্যে চলমান সংঘর্ষে প্রাণ হারাচ্ছে শত শত নিরীহ মানুষ। হাজারো রোহিঙ্গা এবং রাখাইন বৌদ্ধ পরিবার সীমান্তের কাছাকাছি এসে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অনুরোধে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে—একটি সাময়িক “মানবিক করিডোর” (Humanitarian Corridor) গঠনের, যার মাধ্যমে সংঘর্ষকবলিত মানুষজন বাংলাদেশ হয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা পেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—রোহিঙ্গা সংকটে দীর্ঘদিন ধরে জর্জরিত বাংলাদেশ কি আরেকবার মানবিকতার নাম করে একটি নতুন দায়ভার নিজের কাঁধে নেবে? নাকি, এটি একটি কৌশলগত কূটনৈতিক সুযোগ হিসেবেও কাজে লাগাতে পারে?

মানবিক করিডোর কী? কেন এখন প্রাসঙ্গিক?
মানবিক করিডোর হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা পথ, যেখানে নিরস্ত্র শরণার্থী বা সাধারণ নাগরিকরা যুদ্ধ এলাকা থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারে অথবা ত্রাণ সহায়তা পেতে পারে—অস্ত্রবিরতি অথবা সীমিত সময়ের নিরাপত্তা চুক্তির মাধ্যমে। বর্তমানে রাখাইনে যে মাত্রার সংঘর্ষ চলছে (বিশেষ করে বুথিডং ও মংডু এলাকায়), সেখানে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের ভূমিকা প্রত্যাশা করছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত এমনিতেই স্পর্শ করছে রাখাইনের সংকটপূর্ণ এলাকা, ফলে একটি করিডোর তৈরি করা ভৌগোলিকভাবে সম্ভবও।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবতার নজির স্থাপন করেছে। করিডোরের মাধ্যমে এই সংকটে মানবিক সহায়তা প্রদান করলে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে—বিশেষ করে ওআইসি, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে।

করিডোরের ব্যবস্থাপনার বিনিময়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে—
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারবে মিয়ানমারের উপর,
নতুন অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহায়তা পেতে পারে (বিশেষ করে UNHCR ও EU থেকে)
চীন-ভারতের ভারসাম্য নীতিতে নিজেকে কার্যকর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রমাণ করতে পারে।

যদি বাংলাদেশ করিডোরটি শুধুমাত্র সহায়তা পারাপারের জন্য খোলে এবং কোনো শরণার্থী স্থায়ীভাবে না আসে, তাহলে এটি পরিণত হতে পারে একটি আঞ্চলিক মানবিক নীতির মডেল হিসেবে।

তবে ঝুকির দিকটি হচ্ছে, রোহিঙ্গারা আবার ঢুকতে শুরু করলে তা রোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। আগে থেকেই যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও সামাজিক ভারসাম্যে প্রবল চাপ তৈরি করেছে।
(সূত্র: Refugee Crisis Report, UNHCR, 2024)

অন্যদিকে রাখাইনের সংঘর্ষে বিভিন্ন জাতিগত মিলিশিয়া (যেমন: আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি) সক্রিয়। করিডোর ব্যবহারের সুযোগে এরা বাংলাদেশে অস্ত্র ও উগ্রবাদ ঢুকিয়ে দিতে পারে।
(সূত্র: IISS Southeast Asia Strategic Report, 2025)

বাংলাদেশের জনগণ ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গা সংকটে অতিষ্ঠ। নতুন করে রাখাইন থেকে আসা জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিলে তা রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয় হতে পারে এবং সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নাগরিক অসন্তোষ বাড়বে।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা গণহত্যার পর আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের জন্য যেমন আন্তর্জাতিক প্রশংসা বয়ে এনেছিল, তেমনই সময়ের সাথে তা পরিণত হয়েছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বোঝায়। এখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশই ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা’কে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। ফলে এবার কোনো করিডোর খোলার আগে স্পষ্ট শর্ত, সময়সীমা ও তদারক ব্যবস্থাপনা ছাড়া পদক্ষেপ নিলে তা আবার একটি স্থায়ী সংকটে পরিণত হতে পারে।

বাংলাদেশের করিডোর দিতে পারে, তবে শর্তসহ যেমন —
১. কেবলমাত্র ওষুধ, খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রবেশের জন্য করিডোর খুলবে; স্থায়ীভাবে কোনো ব্যক্তি প্রবেশ করবে না
২. জাতিসংঘ ও আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকদের সরাসরি তদারকি নিশ্চিত করতে হবে
৩. করিডোর ব্যবস্থাপনার বিনিময়ে জাতিসংঘের কাছ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রমে শক্তিশালী চাপ ও সময়সীমা চাইতে হবে
৪. সীমান্তে সেনাবাহিনী ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি জোরদার করতে হবে
৫. মিয়ানমার ও চীনের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে লিখিত সমঝোতা করতে হবে যে এই করিডোর “স্থায়ী বা স্থায়ী শরণার্থীর ভিত্তি” হবে না।

মানবতা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিজের সীমা, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এসেছে মানবতা ও কূটনীতিকে একত্রে ব্যবহার করার। কিন্তু এই করিডোর যেন দ্বিতীয় রোহিঙ্গা ঢলে পরিণত না হয়, সে বিষয়ে প্রয়োজন কড়া নজরদারি, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সময়সীমাবদ্ধ নীতি। অন্যথায়, মানবতার দায়ে আরেকবার বাংলাদেশেরই গলার কাঁটা হয়ে উঠবে ‘করিডোর’। শর্ত শুধু একটাই, সিদ্ধান্ত হোক মাথা ঠান্ডা রেখে, আবেগ নয়; কৌশল নয়, আত্মবিসর্জিত উদারতা দিয়ে নয় — এই করিডোর হতে পারে মানবিকতা ও কূটনীতির মিলনস্থল। 

 

শীমুল চৌধুরী: লেখক ও নির্মাতা

shimulmamunic@gmail.com
 

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এসএ

আরও পড়ুন