শিরোনাম
ড. মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন
প্রকাশ: ০৯:১৭, ২৩ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ০৯:২৩, ২৩ জুলাই ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
ভূমিকা: আমরা প্রতিনিয়ত চলছি এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় আত্মবিনাশের (Automatic self-destruct) পথে। আকাশ, রেল, কিংবা সড়ক পথ সব সেক্টরেই চলছে এই আত্মবিনাশী অভিযাত্রা। অনিয়ম, আর দুর্নীতির চোরাবালিতে বন্দি নাগরিক জীবন। প্রতিদিন মানুষ ছুটে চলছে জীবনের ঝুঁকি হাতে নিয়ে এক বিপজ্জনক অভিযাত্রায় যেন চলন্ত বোমার শহরে আমাদের বসবাস। এমতাবস্থায়, সর্বত্র প্রশ্ন উঠছে- রাষ্ট্রযন্ত্রের কি আদৌ কোনো বিকার আছে? নাকি আমরা কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছি সেই পুরোনো চক্রে ?
গণপরিবহন ব্যবস্থা: ঢাকা শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থায় নেই কোনো শৃঙ্খলা। যারা প্রতিদিন এই গণপরিবহনে চলাফেরা করেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন এই লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা পুরোনো বাসে চড়া মানেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করা । পুরোনো, মানহীন ও অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত উদাহরণ এই বাসগুলো। বাস চালকদের অধিকাংশই অদক্ষ, লাইসেন্সহীন, কিংবা মাদকের প্রভাবে নিয়ন্ত্রণ হারানো লোকজন । বাস থামার নির্দিষ্ট স্থান নেই, ওঠানামার নিয়ম নেই, চালকদের সাথে যাত্রীদের ঝগড়া নিত্যদিনের ঘটনা। বিশ্বের আর কোনো সভ্য দেশে এমন ‘চলন্ত মৃত্যু’ (Moving death) নামক বাহন আছে বলে আমাদের নেই। একেকটি বাস যেন মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়ায় প্রতিদিনের যাত্রায়।
আমাদের সবারই মনে থাকার কথা, বিগত সরকারের আমলে এই গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা নিয়েই কিন্তু স্কুল-কলেজের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রাজপথে নেমে এসেছিল? নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে তারা ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারপর কোটা আন্দোলন, যার ধাক্কায় সরকারের বিদায়ও ঘটে। ছাত্রসমাজ তাদের জীবনের নিরাপত্তা, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার দাবিতে একের পর এক সোচ্চার হয়েছে, কিন্তু সিস্টেমের তেমন কোনো পরিবর্তন আদৌ ঘটেনি। বর্তমান সরকার, কিংবা আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তাদের কি এই গণপরিবহন নিয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে? তারা কি পুরোনো সিন্ডিকেট ভেঙে একটি আধুনিক, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবেন নাকি আমরা আবারো আশাহত হব?
রেলপথ: একসময় বাংলাদেশের রেলওয়ে ছিল একটি গর্বের বিষয়। কিন্তু আজ? পুরোনো ইঞ্জিন, ট্রেনের শিডিউলে বিপর্যয়, ভাঙাচোরা কোচ, সিগন্যাল জটিলতা-সব মিলিয়ে এক দুর্ভোগের নাম এখন ট্রেনযাত্রা। স্টেশনগুলোর চেহারা দেখলে মনে হয় কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত সিনেমার সেট। আর ট্রেনের দুর্ঘটনা যেন নিত্য দিনের ঘটনা, তবু, যেন কোনো বার্তাই পৌঁছায় না নীতিনির্ধারকদের কানে।
আকাশ পথ: সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্রটি এখন উঠে আসছে আকাশপথে । আধুনিক জেট বিমানের বদলে পুরোনো ও ব্যবহারের অযোগ্য প্রশিক্ষণ বিমান দিয়ে আজও চলে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়ে একটি প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়েছে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনের উপর। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি হয়েছে, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীসহ অনেকের শরীর আগুনে জ্বলসে গেছে। স্বজনদের আহাজারি আর তাদের আর্ত-চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। এমন মর্মান্তিক ঘটনার পরেও যদি আমাদের বিবেক না জাগে, তবে আর কবে জাগবে?
উত্তরণের উপায়: এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি সুদূরপ্রসারী, জনবান্ধব এবং টেকসই কর্মপরিকল্পনা (Sustainable planning)। প্রথমে, পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন বাতিল করে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ নতুন গণপরিবহন চালু করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ নীতিমালার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বেপরোয়া সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। পাশাপাশি স্মার্ট প্রযুক্তিনির্ভর বৈদ্যুতিক বাস, আধুনিক ট্রেন এবং নিরাপদ জেট বিমানের মাধ্যমে পুরো পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। চালকদের প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স যাচাই ও নিয়মিত ড্রাগ টেস্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে। সর্বোপরি, এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, জবাবদিহি এবং গণশুনানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, একটি জাতির উন্নয়ন শুরু হয় নিরাপদ যাত্রা থেকে।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ