শিরোনাম
রাশেদ আহমেদ রিপন
প্রকাশ: ১৪:৫২, ১৬ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৪:৫২, ১৬ জুন ২০২৫
প্রতীকী ছবি
বাবা ছিলেন একজন বেবিট্যাক্সি চালক। প্রতিদিন ভোর ৬টায় ঘুম ভাঙতো তার — মা চুপিচুপি রুটি দিতেন প্যাকেটে, আর তিনি বেরিয়ে যেতেন রাস্তায়…
সারাদিনের রোদ, ধুলো, ক্লান্তি— সব সয়ে ফিরতেন রাত ১০টার পর।
রিপন বুঝত না ছোটবেলায় বাবার মুখে কেন এত ক্লান্তি, চোখে কেন লুকানো কষ্ট। রিপন ছিল পরিবারের একমাত্র ছেলে। মা-বাবা ও চার বোনের ভালোবাসা তাকে ঘিরে ছিল সবসময়, কিন্তু অভাব ছিল একেবারে হাড়ে গাঁথা।
স্কুলে যেত পুরনো ব্যাগ নিয়ে, পাঁচ টাকার টিফিন মানি হাতে, আর মনে একটাই কথা— ‘একদিন বাবা-মাকে আর এসব কষ্ট করতে দেব না।’
কিন্তু রিপনের শৈশবের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ ছিল— তার সাতজন শৈশবের বন্ধু।
একসঙ্গে স্কুলে যেত, খেলাধুলা করত, পাড়ার গলিতে আড্ডা বসত।
সময় বদলালো। সেই সাত বন্ধুর মধ্যে চারজন এখন বড়লোক— কেউ বাবার গার্মেন্টস সামলাচ্ছে, কেউ বিদেশে।
বাকি তিনজন, রিপনসহ, মধ্যবিত্ত; কিন্তু তাদের বন্ধুত্বে কোনো ছেদ পড়েনি।
রিপন কলেজে ভর্তি হল। বন্ধুরা দামি মোটরবাইকে আসত, আধুনিক পোশাক পরে। রিপন আসত বাবার চালানো বেবিট্যাক্সির পিছনের সিটে বসে— বাবা আগে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে ছেলেকে কলেজে নামিয়ে দিতেন, তারপর নিজের খেটে-খাওয়া দিন শুরু করতেন।
একবার কলেজে ফাদারস ডে উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান ছিল। সব ছাত্রদের বলা হয়েছিল বাবাকে সঙ্গে আনার জন্য।
রিপন প্রথমে যেতে চাইছিল না। ভাবছিল, ‘সবাই যখন স্যুটেড বাবাদের পাশে দাঁড়াবে, তখন আমার বাবাকে দেখলে কী ভাববে?
কিন্তু মজিদ সাহেব গেলেন— চুপচাপ সবার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রিপন দূর থেকে দেখল— বাবা মোবাইল ফোন দিয়ে ছেলের ছবি তুলছেন, চোখে এক ধরনের গোপন গর্ব, এক ধরনের নীরব হাসি।
রিপন তখন আর নিজেকে থামাতে পারেনি। সে মাইক্রোফোনে গিয়ে বলল— ‘এই মানুষটিই আমার হিরো। তিনি সারা জীবন নিজের পছন্দ, নিজের আরাম বিসর্জন দিয়ে আমাকে গড়েছেন। তিনি শুধু আমার বাবা মজিদ নন— তিনি আমার চালক, আমার ছায়া, আমার সবচেয়ে আপন মানুষ।’হলরুম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ কথা বলে না, কেউ চোখের জল লুকায় না।
মজিদ সাহেব শুধু ধীর কণ্ঠে বলেন— ‘রিপন, আমি চাই না তুই গর্ব করিস আমি কী করি তা নিয়ে। আমি চাই, তুই গর্ব করিস আমি কেন করি তা নিয়ে। তুই মানুষ হ, তোর মাথা উঁচু কর— আমার সব কষ্ট সার্থক হয়ে যাবে।’
অনেক বছর ঘুরে গেছে। রিপন এখন ঢাকার এক বড় গার্মেন্টস অফিসে কাজ করে—প্রাইভেট চাকরি, সম্মানজনক পদ। আর অফিসটা? তার শৈশবের বন্ধু সুমনের মালিকানাধীন। সুমন এখন বড় ব্যবসায়ী— কিন্তু বন্ধুত্বে একবিন্দু অহংকার নেই।
সে বলত— ‘বন্ধুদের মধ্যে কেউ মালিক, কেউ কর্মচারী— এতে ছোট হওয়ার কিছু নেই। বড় হলো বন্ধুত্ব, আর সম্মান।
একবার ফাদার’স ডে উপলক্ষে অফিসে একটি প্রেজেন্টেশন হচ্ছিল। সবাই বাবার ছবি দিচ্ছিল— কেউ স্যুটেড, কেউ টাইপরা। রিপন নিজের বাবার একটি ছবি দিল— ধুলোমাখা বেবিট্যাক্সির পাশে দাঁড়িয়ে এক ক্লান্ত মজিদ সাহেব। সবাই অবাক। রিপন ধীর পায়ে মাইক্রোফোনে গিয়ে দাঁড়াল। তার গলা কাঁপছিল, কিন্তু চোখ ছিল স্থির।
সে বলল— ‘আমি এই অফিসে একজন চাকুরে, কিন্তু আমি গর্ব করি কারণ এই অফিস আমার সেই বন্ধুর— যে আজও আমাকে ভাইয়ের মতো দেখে। তবে আজ আমি আপনাদের সামনে এমন একজন মানুষকে তুলে ধরতে চাই— যার কাঁধে চড়ে আমি এখানে পৌঁছেছি। তিনি একজন ড্রাইভার ছিলেন— কিন্তু আমার কাছে, তিনি আমার জীবনের চালক। তিনি মজিদ সাহেব— আমার বাবা। আজও তার স্যান্ডেলের নিচে চাপা পড়ে আছে হাজারো স্বপ্ন, যেগুলো তিনি নিজ হাতে মাটিচাপা দিয়ে গেছেন— যেন আমি আকাশ ছুঁতে পারি।’
সবার চোখে জল। নীরবতা ঘিরে ফেলে ঘরটাকে। সুমন উঠে দাঁড়িয়ে বলে— ‘রিপন, তুই আমার কর্মচারী না, তুই আমার অনুপ্রেরণা। তোর বাবার মতো বাবারাই আসল হিরো। একজন বাবা হয়তো স্যুট পরে অফিসে যান না, কিন্তু তার ঘামে ভেজা শার্টেই লেখা থাকে সন্তানের ভবিষ্যৎ।’
শুভ বাবা দিবস। ‘বাবারা হয়তো ছবি হয়ে দেয়ালে ঝুলে থাকেন, কিন্তু জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তারা হয়ে থাকেন ছায়া— নিঃশব্দ, কিন্তু অমূল্য।’
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ