ঢাকা, শুক্রবার, ০১ আগস্ট ২০২৫

১৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৫ সফর ১৪৪৭

রাজনীতির চালাকি ও আম জনতা-বোকা হদ্দের গল্প

এস এম মুকুল

প্রকাশ: ১১:১২, ৩১ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ১১:১৩, ৩১ জুলাই ২০২৫

রাজনীতির চালাকি ও আম জনতা-বোকা হদ্দের গল্প

ছবি: সংগৃহীত

কথায় আছে অতি চালাকের গলায় দড়ি! সমাজে কিছু চালাক মানুষ আছে। অথবা কিছু মানুষ নিজেকে খুব চালাক মনে করে। কিন্তু তারা জানে না যে- তাদের চালাকি মানুষ বুঝতে পারে। এদের মধ্যে ধুর্ত শ্রেণির মানুষগুলো সাংঘাতিক। আর কিছু মানুষ আছে সবকিছুতে চালাকি করে। এই চালাকির প্রবণতা-প্র্যাকটিস অনেকের মাঝে তীব্রতর চারিত্রিক গুণে পরিণত হয়। তারা অতি সাধারণ, স্বাভাবিক কথা বা কাজের ক্ষেত্রেও অস্বাভাবিকভাবে চালাকির আশ্রয় নিয়ে থাকে। এটা অভ্যাসের দোষ।

তবে চালাকি আর বুদ্ধির খেলা এক নয়। কিন্তু দুটোই বুদ্ধি দিয়ে করতে হয়। বুদ্ধি মানুষের এমন একটি সম্পদ- যা দিয়ে ভাল এবং মন্দ দুই ধরণের কাজই করা যায়। যেমন শয়তান বুদ্ধি দিয়ে দুষ্ট কাজ করে থাকে, কিন্তু ইমানদার বা মোমিন লোক বুদ্ধিকে ভালো কাজে ব্যয় করে। যাহোক আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল পর্যালোচনা করলে এমনসব দুষ্ট বুদ্ধি আর চালাকির হলহর্দ লক্ষ্যণীয় হয় যে তাকে কেবল সার্কাসই মনে হতে পারে। যেমন চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এখানে কোনো দল বলছে- এই অভ্যুত্থান একটা মেটিকুলাম ডিজাইন। প্রধান উপদেষ্টা স্বগর্বে আমেরিকায় অনুষ্ঠানে মেটিকুলাস ডিজাইনার বা মাস্টারমাইন্ডকে বিশ্বের কাছে প্রকাশ করেছেন। পরবর্তী সময়ে আমরা শুনেছি তিনি নিজেকে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দাবি করেননি! কিন্তু মেটিকুলাস ডিজাইনকে আকারে-প্রকারে স্বীকার করে নিয়েছেন। আবার এখন দেখছি সেই ব্যক্তিটিই বলছেন- জুলাই আন্দোলনের একটা পর্যায় ছিলো মেটিকুলাস ডিজাইন এবং বাকিটা ছিলো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। এসব কথাবার্তা শুনে মনে হয়- তাহাদের অপরিপক্ক চালাকি আর অপরিণত বুদ্ধির সার্কাস দেখছি আমরা। তাই আম জনতার মনে প্রশ্ন জাগছে- জুলাই আন্দোলন কি এই সার্কাস দেখার জন্য হয়েছিলো!

রাজনীতিতে বুদ্ধির ব্যবহার ও চালাকির প্রবণতা একটা শিল্প পর্যায়ের খেলা। রাজনীতি এই খেলা খুব উপভোগ্য। কিন্তু আমরা যা দেখছি তা দেখে তো এটা শিল্প বলার সুযোগ থাকছে না! বরং সার্কাস বলা যেতে পারে। যেমন ধরা যাক- প্রধান উপদেষ্টা দেশে এসে প্রথম মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন- আমার নিয়োগকর্তা ছাত্র-সমাজ। আবার জুলাই আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা পরবর্তী সময়ে বলেছেন- উপদেষ্টার নিয়োগকর্তা আমরা নই। আমরা চাপে পড়ে এটা করেছি! আবার প্রধান উপদেষ্টা অভিমান করে পদত্যাগের কথা জানিয়েছিলেন ছাত্র নেতাদের মাধ্যমে! কী একটা সার্কাস সার্কাস অবস্থা হয়ে গেল না!

পটপরিবর্তনের পরবর্তী রাজনীতিতে বিএনপি, জামাত ও নব গঠিত এনসিপির কার্যকলাপ, আচরণ এবং কথাবার্তা শুনে জাতি হতাশ! জাতি বুঝতে পারছে কী কারণে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে? একটি দলকে দেশছাড়া করা ছাড়া আমরা কি পেলাম?

যাহোক জনগণের আশা-ভরসার জায়গা নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না এমনটাই মনে করছে আম-জনতা। লন্ডন বৈঠকে একটা আশা ছড়িয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু শঙ্কা কাটেনি! সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হবে কি হবে না এনিয়ে আছে বিতর্ক? এইসব যদি, কিন্তু, হইতে, থেকে-ছে এই অবস্থার প্রেক্ষাপট দেখে বোকা হদ্দের গর্তে খুড়ার কথা মনে পড়ে গেল।

এক বোকা হদ্দকে গর্ত খুড়তে দেখে চালাক লোকটি বললো- কী হদ্দ, গর্ত খুড়ছো কেন? হদ্দের জবাব- গর্ত খুড়ছি হাফ ছবি তোলার জন্য! চালাক লোক : হাফ ছবি তোললে গর্ত খুড়তে হবে কেন? হদ্দ: আরে মশাই, বুক অব্দি গর্ত করে আমি গর্তে গিয়ে দাড়ালেই তো আমার হাফ ছবি (বুকের উপরের অংশ) তোলা হয়ে যাবে! চালাক : তো তোমার কয় কপি ছবি তোলতে হবে?

হদ্দ: তিন কপি। চালাক : তাহলে তো তোমাকে তিনটি গর্ত খুড়তে হবেরে হদ্দ! এই গল্প থেকে যার যা বুঝার বুঝে নিন।

কথা হচ্ছে রাজনীতি ছাড়া দেশ চলবে না। আর রাজনীতি যতদিন থাকবে ততদিন আম-জনতার (হদ্দের) সাথে এমন গল্প চলতেই থাকবে হয়তো! তো চালাকির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি পর্যায় বা ব্যবহার আছে। যেমন- চালাক: এমন কেউ যার বুদ্ধি সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় বা প্রাসঙ্গিক ভাবে ব্যবহার করা হয়। চতুর: এমন কেউ যিনি সব বিষয়ে বা পরিস্থিতিতে সবকিছু বহুমুখী হয়ে চিন্তা করতে পারেন। মাল্টিডাইম্যানশনাল থিংকিং আরকি! ধূর্ত: এমন কেউ যে নিজের স্বার্থে বুদ্ধির ব্যবহার করে, ন্যায় অন্যায়, ধর্ম অধর্মের বিচার কওে না। কেবল নিজের লাভের জন্য বা অন্যের ক্ষতির জন্য নিজের বুদ্ধির ব্যবহার করে। বুদ্ধিমান: এমন কেউ যিনি কোনো বিষয়বস্তুকে বুঝবার ও বিবেচনা করার সময় আবেগ ও যৌক্তিক বিশ্লেষণ করার তফাত করতে সক্ষম।

যাহোক বুদ্ধির ব্যবহার যে যেভাবেই করুন না কেন, মনে রাখতে হবে- কাউকে ঠকালে ঠকবেন আপনিও! এটা প্রকৃতির নিয়ম। কারো হক নষ্ট করলে, কারো অধিকার খর্ব করলে আপনার হক বা অধিকার কোনো না কোনোভাবে নষ্ট হবেই। কবিতার ভাষায় বলতে গেলে- ‘যুগের ধর্ম এই- পীড়ন করিলে সে পীড়ন আসিয়া পীড়া দিবে তোমাকেই’! বর্তমান রাজনীতির যে প্রতিফলন তা কিন্তু পীড়নের প্রতিফলন মাত্র। রাজনীতির এই অচলাবস্থা কিন্তু রাজনৈতিক দক্ষতার চরম ব্যর্থতার নজির।

আবারো বলবো- চালাকি এক ধরনের কৌশল বা প্রবণতা, যা কখনো মানুষকে জয়ী করে তোলে, আবার কখনো নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনে। চালাক হওয়া ভালো, কিন্তু অতিরিক্ত চালাকি মাঝে মাঝে বিশ্বাস হারিয়ে দেয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই চালাকির এক গভীর প্রভাব আছেÑ চেনা মানুষ, অচেনা পরিস্থিতি, বন্ধু, শত্রু, সবার মাঝেই এ খেলা চলতে থাকে।

মনে রাখা দরকার যে সকলেরই নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান ও চালাক মনে করার প্রবণতা থাকে। তবে, এই প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ যাতে এটি আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অন্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করার ক্ষেত্রে প্রভাবিত না করে।

এবার চালাকি নিয়ে একটি কৌতুক শোনা যাক- পিঁপড়ার কাছ থেকে চিনি রক্ষা করার জন্য বোকারা চিনি লুকিয়ে রাখে, আর চালাকেরা নাকি চিনির গায়ে লবণ লিখে দেয়। স্কুল/কলেজ থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য বোকারা প্রধান শিক্ষকের কাছে দরখাস্ত লেখে, আর চালাকেরা স্কুলে একটা অঘটন ঘটায়। সুন্দর হওয়ার জন্য বোকারা রূপচর্চা করে, আর চালাকেরা ফটোশপ শেখে। ক্যাডার হওয়ার জন্য বোকারা দিনরাত পড়াশোনা করে, আর চালাকেরা দিনরাত মারামারি করে। সেলিব্রিটি হওয়ার জন্য বোকারা মডেলিং-নাটক-সিনেমা করে, আর চালাকেরা ‘হিরো আলমিজম’ করে। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে বোকারা কোল্ড ড্রিংকস কেনে, আর চালাকেরা শপিং কমপ্লেক্সে ঢোকে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিনা, সেটা দেখার জন্য বোকারা জানালা খুলে বাইরে তাকায়, আর চালাকেরা ফেসবুকে লগইন করে- ‘বৃষ্টি হচ্ছে কি!’

রাত গভীর দেখে বোকারা ঘুমিয়ে পড়ে, আর চালাকেরা প্রভাত নিকটে দেখে জেগে থাকে। বিয়ে করার জন্য বোকারা পালিয়ে যায়, আর চালাকেরা পরীক্ষায় ফেল করে। হা হা হা। চালাকির পরিণতি কেমন হয় এ নিয়েও একটি কৌতুক গল্প জানা যেতে পারে।

মিষ্টি বিক্রেতা মনে করে আমি তো মিষ্টি খাই না, তাই মিষ্টিতে ভেজাল মেশালে আমার কোনো সমস্যা নাই। বেকারির মালিক মনে করে, আমি তো বিস্কুট খাই না, তাই পচা ডিম ময়দা দিয়ে বিস্কুট বানালে আমার কোনো সমস্যা নাই। ফল বিক্রেতা মনে করে আমি তো ফল খাই না, তাই ফলে কেমিক্যাল দিলে আমার কোনো সমস্যা নাই। মাছ বিক্রেতা মনে করে আমি এই মাছ খাব না, তাই মাছে ফরমালিন দিলে আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু দিনের শেষে- মিষ্টি বিক্রেতা মিষ্টি বিক্রি করে বিস্কুট, ফল, মাছ কিনে নিয়ে বাসায় যায়।

বেকারির মালিক বিস্কুট বিক্রি করে মিষ্টি, ফল, মাছ কিনে নিয়ে বাসায় যায়। ফল বিক্রেতা ফল বিক্রি করে মিষ্টি, বিস্কুট, মাছ কিনে নিয়ে বাসায় যায়। মাছ বিক্রেতা মাছ বিক্রি করে ফল, বিস্কুট, মিষ্টি কিনে নিয়ে বাসায় যায়। এরা সবাই মনে মনে নিজেকে অনেক চালাক ভাবে, বেশি লাভ করছে ভেবে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। আসলে তারা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছে, অন্যের ক্ষতি করতে গিয়ে নিজেদেরই ক্ষতি করছে — তা তারা বুঝতেও পারে না!

এস এম মুকুল: লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন