শিরোনাম
শীমুল চৌধুরী
প্রকাশ: ১৩:৪৩, ৫ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৫৪, ৫ মে ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
যৌনকর্মকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি: যুক্তি ও বাস্তবতা
অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অধিকারকর্মীরা যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাদের মতে, এই স্বীকৃতি দিলে যৌনকর্মীরা স্বাস্থ্যসেবা, সুরক্ষা এবং সামাজিক স্বীকৃতির আওতায় আসবেন। বাংলাদেশেও এই দাবি নতুন নয়; ২০১৮ সালের মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশসহ বিভিন্ন গবেষণাতেই এই বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো— এই স্বীকৃতি যদি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার মধ্যে প্রদান করা হয়, তাহলে তা শোষণকারীদের হাতেরই অস্ত্র হয়ে যেতে পারে।
পতিতাবৃত্তির ফাঁদ: কে ঠেলে দিচ্ছে, কেন?
বাংলাদেশে বিশেষত দরিদ্র গ্রামীণ অঞ্চল থেকে আসা অনেক নারীকেই প্রতারণার মাধ্যমে যৌনপল্লীতে আনা হয়। ‘গার্মেন্টসে কাজ’ কিংবা ‘বাসার চাকরি’ দেওয়ার কথা বলে ১৪-১৫ বছরের কিশোরীদের শহরে এনে বিক্রি করে দেওয়া হয় দালাল চক্রের হাতে। এদের পেছনে থাকে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী— যাদের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা মাফিয়া, প্রভাবশালী এনজিও কর্মকর্তা, দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এই গোষ্ঠী একধরনের শ্রেণিশক্তি গড়ে তুলেছে, যারা দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে। তারা জানে, একজন দরিদ্র নারীর বিকল্প আয়ের উৎস সীমিত, তার সামাজিক সুরক্ষা দুর্বল এবং আইনি প্রতিকার প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে পতিতাবৃত্তি হয়ে ওঠে তার ‘অবধারিত পরিণতি’; যা আসলে পূর্বপরিকল্পিত ফাঁদের ফল। যখন এই পেশাকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়, তখন এই গোষ্ঠীর পক্ষে নারীদের এখানে ঠেলে দেওয়া আরও সহজ হয়ে যায়। কারণ তখন তারা বলতে পারে— ‘এটা তো বৈধ কাজ, তুমি কেন আপত্তি করছো?’ এভাবেই ‘আইনি পেশা’ আর ‘আইনি জোর’ মিলিয়ে নারীদের জীবনের ওপর গড়ে ওঠে শোষণের আরেকটি আইনসম্মত কাঠামো।
আইন ও নীতির সীমাবদ্ধতা
যৌনকর্মীদের শ্রমিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে, সেই সঙ্গে আসবে নিয়ন্ত্রণ, রেজিস্ট্রেশন, শর্তযুক্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এমনকি নির্দিষ্ট এলাকা ও সময় নির্ধারণের মতো বিষয়। যেহেতু এই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করবে মূলত স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ— তাদের দুর্নীতিপূর্ণ আচরণ যৌনকর্মীদের জীবনকে আরও অনিরাপদ করে তুলতে পারে। বলা হয়ে থাকে, ‘আইন একটি শ্রেণির শোষণ করার হাতিয়ার— সেই আইন সব সময় সমাজের শক্তিশালী গোষ্ঠীর পক্ষে যায়।’ আমাদের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় এই প্রবাদটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: সতর্ক হওয়ার শিক্ষা
নেদারল্যান্ডস, জার্মানি বা থাইল্যান্ডে যৌনকর্মকে বৈধতা দেওয়া হলেও সেখানে মানব পাচার বন্ধ হয়নি, বরং তা বেড়েছে। এই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে—শুধু আইনি স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়, বরং সুরক্ষা কাঠামো, বিকল্প পেশার সুযোগ এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। বাংলাদেশ যেখানে এখনও নারী নির্যাতনের বিচারই নিয়মিত হয় না, সেখানে যৌনকর্মীদের শ্রমিক স্বীকৃতি দিয়ে সমস্যা আরও কাঠামোবদ্ধ করা হতে পারে।
মুক্তির নামে নতুন বন্দিত্ব?
যৌনকর্মীদের শ্রমিক স্বীকৃতি যদি দিতে হয়, তবে তার আগে দরকার একটি শক্তিশালী নীতিমালার, যেখানে প্রতিটি স্বীকৃতির প্রক্রিয়া হবে স্বেচ্ছাসেবী, দালালমুক্ত এবং সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা-নির্ভর। দরকার শিক্ষার সুযোগ, বিকল্প জীবিকার পথ এবং আইনি সহায়তা। না হলে এই স্বীকৃতি হবে কাগজে কলমে মর্যাদার আর প্রতিশ্রুতির। কিন্তু বাস্তবে শোষণের বৈধ লাইসেন্স। এই স্বীকৃতি যেন না হয়ে ওঠে দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে পড়া নারীর ‘শোষণের নব রূপ’— সেদিকে আমাদের চোখ খোলা রাখা জরুরি।
শীমুল চৌধুরী: লেখক ও নির্মাতা
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ