ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

১৫ বৈশাখ ১৪৩২, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম

Scroll
২৯ এপ্রিল থেকে সারাদেশের সব পলিটেকনিকে শাটডাউন ঘোষণা
Scroll
হজ ফ্লাইট উদ্বোধন, প্রথম দিনে মোট ১০টি ফ্লাইটে ৪ হাজার ১৮০ জন হজযাত্রী সৌদি যাবেন
Scroll
চট্টগ্রাম টেস্ট, প্রথম দিন: বাংলাদেশের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের প্রথম ইনিংসে সংগ্রহ ৯০ ওভারে ২২৭/৯
Scroll
ইয়েমেনের বন্দিশালায় মার্কিন বিমান হামলা, ৬৮ মৃতদেহ উদ্ধার
Scroll
ডনসহ ১৬ পাকিস্তানি ইউটিউব চ্যানেল নিষিদ্ধ ভারতে, বিবিসিকে সতর্কবার্তা
Scroll
সারাদেশে বজ্রপাতে প্রাণ গেল ১০ জনের
Scroll
নারী বিবেচনায় জামিন পেলেন মডেল মেঘনা আলম
Scroll
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর গঠন
Scroll
ঢাকায় ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
Scroll
রাখাইনের জন্য করিডোর দিতে সম্মত বাংলাদেশ
Scroll
নতুন এক লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ: নতুনদের ঘর করে দিতে জাতিসংঘের চিঠি

‘মতিঝিল’ যেন এক ভাঙা হাট

প্রকাশ: ১৯:৫১, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

‘মতিঝিল’ যেন এক ভাঙা হাট

‘মতিঝিল’ যেন ভাঙা হাট । ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি অনেক দিন পর মতিঝিল গিয়েছিলাম স্কুল বন্ধু লুৎফরের অফিসে। কৃষিবিদ লুৎফর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব। বেলা সোয়া এগারোটায় ওর অফিস ৯৯ হোল্ডিং-এর  মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় পাট অধিদপ্তরে পৌঁছাই।

ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের মধ্যে কাজ শেষ করে লুৎফরের অফিস থেকে বের হই। আকস্মিক মনে হলো অপরিচিত কোনো এলাকায় ভুল করে এসে পড়েছি। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা, মানুষের ভীড় একেবারে নেই, যানবাহন কম, এমনকি মূল সড়কেও বাস, গাড়ি, রিকশার হাক-ডাক কিংবা হর্ন নেই। সামনে সুউচ্চ জনতা ব্যাংক ভবন ও সামান্য দক্ষিণে বিমান অফিস দেখে নিশ্চিত হলাম আমি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে আছি। মতিঝিলের এমন সুনসান নীরবতা আগে কখনো দেখিনি।

মনে হলো এ যেন এক ভাঙা হাট।

অথচ আশি, নব্বই এর দশক, এমনকি পাঁচ ছয় বছর আগেও মতিঝিল হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর থাকতো। এমনকি মতিঝিলের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোও সর্বদা লোকে গম গম করতো।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং মধুমিতা হলের মধ্যবর্তী সড়ক থাকতো সেকেন্ডারি ক্ষুদ্র শেয়ার ব্যবসায়ীদের দখল। নাকি সড়কেও ট্র্যাফিক জ্যাম ছিলো নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার। সকাল আটটা থেকে রাত নয়টা দশটা পর্যন্ত মতিঝিল এলাকায় অসম্ভব ভীড় লেগে থাকতো। মূল মতিঝিলতো বটেই সংলগ্ন দিলকুশা, টিকাটুলী, আর কে মিশন রোড, টয়নবি সার্কুলার রোড, গুলিস্তান, স্টেডিয়াম, জিপিও, পুরানা পল্টন, সেগুন বাগিচা, বিজয় নগর, আরামবাগ, ফকিরাপুল, নয়া পল্টন, কাকরাইল পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য থাকতো।  

মূলত সত্তর দশক থেকে বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে মতিঝিলের গুরুত্ব বাড়তে থেকে। প্রথম দিকে জহুরুল ইসলামের ইসলাম গ্রুপের টয়োটা বিল্ডিং ও পরে আশি’র দশকে স্টেডিয়ামের পুর্ব গ্যালারি সংলগ্ন স্থানে গড়ে ওঠে চব্বিশ তলা শিল্প ব্যাংক ভবন। পরবর্তীতে মতিঝলে আরো অনেকগুলো সুউচ্চ ভবন তৈরি হয়। জীবন বীমা, জনতা ব্যাংক, পুবালী ব্যাংক, সেনা কল্যাণ ও বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন এদের অন্যতম। মতিঝিলে সর্বশেষ চার পাঁচ বছর আগে গড়ে ওঠেছে ৩৭ তলা বিশিষ্ট সিটি সেন্টার। 

মতিঝিল এলাকাটি বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত হওয়ার মূল কারণ ছিলো দেশের প্রায় সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বীমার প্রধান কার্যালয় এখানে স্থাপন করার জন্য।   

এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার অফিসও মতিঝিলে রয়েছে। পাশের সেগুন বাগিচায় অবস্থিত বাংলাদেশ সচিবালয়, যেখানে রয়েছে সরকারের প্রায় সকল মন্ত্রণালয়। এ সকল দপ্তর, সংস্থা ও সচিবালয়ে কর্মরত প্রায় কয়েক লাখ কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তারা বসবাস করেন পুরো রাজধানী ও তার আশে পাশের এলাকা জুড়ে।

সকাল হলেই তাই মতিঝিলের চারপাশ অর্থাৎ ঝিগাতলা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী, মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা, বাসাবো, যাত্রাবাড়ি, গেন্ডারিয়া এমনকি সাভার, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে মানুষের বিপুল স্রোত এসে মিশতো মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকায়।      

এতো গেলো কেবল বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কথা। রাজনৈতিক দলগুলোর জনসভা ও শোডাউনও ছিলো মতিঝিলকেন্দ্রিক। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গুলিস্তান, মুক্তাঙ্গন, জিপিও মোড়, প্রেসক্লাব, দৈনিক বাংলা মোড়, পল্টন, মতিঝিল শাপলা চত্বরের মতো স্থানগুলো ছিলো রাজনৈতিক দলগুলোর জনসভার স্থান।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন দলের জনসভায় এই এলাকাগুলো কানায় কানায় পূর্ণ থাকতো। যুগপথ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সকল রাজনৈতিক দল একই দিনে সমাবেশ করতো। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বিএনপি গুলিস্তান চত্বর, সিপিবি ও বাম জোট প্রেস ক্লাব বা মুক্তাঙ্গন এবং জামায়াতে ইসলামীকে শাপলা চত্বরে একই দিনে সমাবেশ করতে দেখা গেছে। ১৯৮৫ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এমন যুগপথ কর্মসুচী অসংখ্যবার দেখা গেছে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত মতিঝিল এলাকায় আমার নিয়মিত যাতায়ত ছিলো। যে দিন এ ধরনের কোনো সভা সমাবেশ হতো সে দিন মতিঝিল থাকতো লাখ লাখ জনতার পদভারে প্রকম্পিত।  

আশি ও নব্বই দশকে খেলা দেখতে মতিঝিল সংলগ্ন ঢাকা স্টেডিয়ামে আসতেন হাজার হাজার ক্রীড়াপ্রেমী দর্শক। ফুটবল, ক্রিকেট তখন ছিলো সমান জনপ্রিয়। আবার সেই স্টেডিয়ামে একই সঙ্গে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা পালাক্রমে অনুষ্ঠিত হতো।

বছরের সাত মাস ফুটবল লীগ আর পাঁচ মাস ক্রিকেট লীগ চলতো। ঢাকার জনপ্রিয় ক্লাব দলগুলো লীগে অংশ নিতো। মোহামেডান, আবাহনী, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারী, আরামবাগ, মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ বীমা, ইস্ট অ্যান্ড, বিমান সহ আরো অনেকগুলো ক্লাব। সব দলের মধ্যে মোহামেডান ও আবাহনীর জনপ্রিয়তা ছিলো সবচেয়ে বেশি। দর্শকদের মধ্যে এই দুটি ক্লাবের সমর্থকই ছিলো সিংহ ভাগ। এ দুটো দলের খেলা যে দিন হতো সে দিন খেলা শুরুর তিন-চার ঘণ্টা আগেই স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেতো। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পাশের মতিঝল এলাকাতেও পড়তো। আমরা টেলিভিশনে দেখতাম স্টেডিয়ামে ঢুকতে না পেরে অনেক দর্শক পার্শ্ববর্তী মতিঝিলের উচু ভবনগুলোতে ওঠে খেলা দেখছেন।  

এই ঢাকা স্টেডিয়ামে অনেকগুলো ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ ও এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপ মহাদেশের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছে একাধিকবার। শুধু তাই নয় ১৯৯৮ সালে এই ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছে নক আউট বিশ্ব কাপ টুর্নামেন্ট। সেখানে ক্রিকেট পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড সহ সকল দেশ ক্রিকেট খেলেছে। সে সময় স্টেডিয়াম থাকতো হাজারো দর্শকে ভরপুর। 

১৯৮৫ সালে ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকায় হয়েছিলো সাফ গেমস। প্রায় মাসব্যাপী স্টেডিয়াম সহ আউটার স্টেডিয়াম, বক্সিং স্টেডিয়াম, কাবাডি স্টেডিয়াম, হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম সহ পুরো এলাকা ছিলো সাতটি দেশের ক্রীড়াবিদ, কোচ, অফিসিয়াল ও দর্শকে ঠাঁসা। ঐতিহ্যবাহী অনেকগুলো ক্লাব মতিঝিল ও সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত।

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, ফকিরের পুল ইয়ং ম্যানস ক্লাব ও আরামবাগ ক্রীড়া চক্র এদের অন্যতম। বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল ব্যাংক পাড়া হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও একে অফিস পাড়া, ক্লাব পাড়া হিসাবেও কেউ কেউ চেনেন। আসলে এতোসব কথার অবতারণা কেবল মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার এমন নীরব রূপ দেখে।  

মতিঝিলের এই হালের কারণ কী? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মতিঝিল পাড়ায় অফিসে পৌঁছাতে এবং অফিস শেষে ঘরে ফিরতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হতো। মতিঝিলগামী ও ফেরত মানুষগুলো মাত্রাতিরক্ত জ্যামে পড়ে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গ্রাহক ও সেবাগ্রহীতারা পড়তেন চরম ভোগান্তিতে। এ অবস্থায় অধিকাংশ ব্যাংক ও বীমার প্রধান কার্যালয় ও প্রিন্সিপাল শাখা মতিঝিল থেকে স্থানান্তরিত করে তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার, মহাখালী, গুলশান, বনানী, উত্তরা এমনকি মিরপুর এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।   

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর কিছু অংশ স্থানান্তরিত হয়েছে মহাখালী ও উত্তরা এলাকায়। ইসলাম গ্রুপের ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের অফিস নেওয়া হয়েছে বনানীর কামাল আতার্তুক এভিনিউতে। মতিঝিলের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, রমনার বিটিআরসি, পল্টনের জিপিও, সেগুনবাগিচার রাজস্ব অফিস সহ আরো বহু অফিস স্থানান্তর করা হয়েছে আগারগাও প্রশাসনিক এলাকায়।   

অন্যদিকে জনপ্রিয় ক্রিকেট খেলা ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে মিরপুর স্টেডিয়ামে। আর ফুটবল লীগও ঢাকা স্টেডিয়ামে গত এক দশক ধরে অনিয়মিত। 

গত পনের ষোল বছর শেখ হাসিনার শাষনামলে বিরোধী দল ও মত ছিলো কঠোর নিয়ন্ত্রিত। তাই মতিঝিল শাপলা চত্বর, গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা মোড়ের মতো স্থানে হয় না কোনো রাজনৈতিক সভা ও সমাবেশ।   

এমন পরিস্থিতে মতিঝিলের অনেক ভবন এখন পড়ে আছে প্রায় খালি। ভবনগুলোর মালিক পাচ্ছেন না কোনো ভাড়াটিয়া। সেখানে এখন ঝুলছে টু লেট। ক্ষতির মুখে পড়েছেন ভবন মালিকরা। 

যদিও মতিঝিলকেন্দ্রিক যাতায়াতকে নির্বিঘ্ন করতে বিগত সময়ে যানজট নিরসনে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো, কিন্তু দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে তা বাস্তবায়নে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। মেট্রোরেল ও উড়াল সড়ক বছর খানেক আগে চালু হলেও তার আগেই ব্যাংক, বীমা ও বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের অফিস মতিঝিল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।  

মেট্রোরেল ও উড়াল সড়ক চালু হওয়াতে যানজটের প্রকটতা কিছুটা কমেছে বটে; তবে ফিরে আসেনি মতিঝিলের আগের মতো কর্মচঞ্চলতা। আসবে কি ফিরে আবার নব উদ্যোমে মতিঝিলের প্রাণচঞ্চল পরিবেশ? নাকি মতিঝিল টিকে থাকবে এমন ভাঙা হাটের মতোই?   

 

মোহাম্মদ মাসুদ খান : সাধারণ সম্পাদক, শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, ঢাকা

 

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এসএ 

আরও পড়ুন