শিরোনাম
শীমুল চৌধুরী
প্রকাশ: ২১:৪২, ২৮ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ২১:৫০, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
আজকের দুনিয়ায় একজন মানুষ কী সত্য এবং কী মিথ্যা—এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব, এক্স (পুরোনো টুইটার) কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের একটি ভিডিও বা বার্তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে লাখো মানুষের মাঝে। তার অধিকাংশই যাচাই-বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করে নেয়। কিন্তু সেই কনটেন্টটি যদি কোনো এআই জেনারেটেড হাইপাররিয়েল ভিডিও হয়? যদি মুখটা হুবহু পরিচিত কেউ হন, কিন্তু কথাগুলো তিনি বলেননি? এটাই হলো বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়ানক দিক।
ফেক নিউজের রূপ ও রসায়ন
ফেক নিউজের ইতিহাস খুব নতুন নয়। আগেও ছিল, তবে এখন তার রূপ বদলেছে। এক সময়ের হলুদ সাংবাদিকতা আজ পরিণত হয়েছে ডিজিটাল চক্রান্তে। কিছু মানুষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, কেউ সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে, আবার কেউ নিছক ‘ভিউ’ বা ‘লাইকের’ আশায় গুজব ছড়িয়ে দেয়। এদের মধ্যে অনেকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীভিত্তিক, আবার অনেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রপাগান্ডার অংশ। সমস্যার গভীরতা বুঝতে হলে আমাদের দেখতে হবে, গুজব কীভাবে কাজ করে।
একটি উদাহরণ দিই: ২০২৪ সালে বাংলাদেশের একটি এলাকায় শিশুচোর সন্দেহে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে জানা যায়, পুরো ঘটনাটি একটি ফেসবুক লাইভ ও কয়েকটি বিভ্রান্তিকর মেসেজের কারণে ঘটেছিল। মূল তথ্য ছিল মিথ্যা, কিন্তু সেটাই ‘সত্যের চেহারা’ হয়ে উঠেছিল জনমানসে।
এআই: সত্য ও মিথ্যার নতুন নাট্যকার
এআই এখন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে শব্দ, ছবি, এমনকি চলমান ভিডিওও মুহূর্তেই বানানো সম্ভব। এগুলোকে বলা হয় "deepfake" বা “synthetic media”। রাজনীতিবিদদের মুখে মিথ্যা বক্তব্য বসিয়ে দেওয়া, সাংবাদিকের কণ্ঠে মনগড়া তথ্য প্রচার করা, কিংবা সাধারণ মানুষের মুখ ব্যবহার করে অপরাধে জড়িয়ে দেওয়া—সবই এখন সম্ভব।
২০২৩ সালের এক ঘটনা মনে করা যাক। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে বলছেন। পরে জানা যায়, সেটি একটি ডিপফেইক ভিডিও ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনীয় সেনাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া।
এখন প্রশ্ন হলো—এই ধরণের ‘নকল সত্য’ যদি এতো নিখুঁতভাবে তৈরি হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবে কোনটা সত্য আর কোনটা বানানো?
সাংবাদিকতার অস্তিত্ব সংকট
এই পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের ভূমিকা আরও কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগে যেখানে রিপোর্টাররা মাঠে গিয়ে খবর সংগ্রহ করত, এখন তাদের এক হাতে কলম, আরেক হাতে চেকিং টুল। সত্য যাচাই করতে হয় একাধিক সোর্স, ফ্যাক্টচেক ওয়েবসাইট, রিভার্স ইমেজ সার্চ ও নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ভুল করলে কেবল পত্রিকার সুনামই নয়, সমাজে বিভ্রান্তিও তৈরি হয়।
তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো, অনেক সংবাদমাধ্যমই এখন ভিউ ও রেটিংয়ের পিছনে দৌড়ায়। ফলে তারা নিজেরাই কখনো কখনো যাচাই না করে খবর ছাপিয়ে ফেলে, যা ফেক নিউজের ইন্ধন জোগায়।
মানুষের মনস্তত্ত্বও বড় কারণ
গবেষণা বলছে, মানুষ এমন তথ্য সহজে বিশ্বাস করে যেটা তার নিজস্ব বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়। অর্থাৎ আপনি যদি কোনো রাজনৈতিক দলকে অপছন্দ করেন, তাদের বিরুদ্ধে বানানো মিথ্যা খবরকেও সত্য বলে বিশ্বাস করবেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘confirmation bias’ এতটাই শক্তিশালী যে মানুষ নিজেই সত্য-মিথ্যার মধ্যকার সীমা মুছে ফেলছে।
সমাধানের উপায় কী?
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ সহজ নয়, তবে কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব—
১. ফ্যাক্টচেক প্ল্যাটফর্ম বিস্তৃত করা: বাংলাদেশে যেমন “Rumor Scanner” বা “BD FactCheck” আছে, সেগুলোর মতো নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে।
২. সাংবাদিকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ: এআই ডিটেকশন, ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স (OSINT), রিভার্স ইমেজ ও ভিডিও যাচাইয়ের কৌশল শেখাতে হবে সাংবাদিকদের।
৩. আইন ও নীতিমালা: গুজব ছড়ানো, ডিপফেইক তৈরি করা বা এআই দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির বিরুদ্ধে কড়া আইন থাকা জরুরি। তবে যেন তা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে, সেটাও দেখতে হবে।
৪. সাধারণ মানুষের সচেতনতা: স্কুল-কলেজ থেকেই মিডিয়া লিটারেসি শেখাতে হবে। মানুষ যেন কোনো খবর শোনামাত্র শেয়ার না করে, বরং যাচাই করে দেখে।
৫. টেক কোম্পানির দায়বদ্ধতা: ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও কঠোরভাবে কনটেন্ট মনিটরিং করতে হবে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সংঘাতপূর্ণ সময়গুলোতে।
শেষ কথা: সত্যের পাশে দাঁড়ানোই সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ
বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতা যেন একধরনের যুদ্ধ। একপাশে প্রযুক্তির সীমাহীন সম্ভাবনা, আরেকপাশে মিথ্যার বিস্তার। এই যুদ্ধের ময়দানে জয়ী হওয়ার একমাত্র উপায় হলো—সত্য ও নিরপেক্ষতার প্রতি অটল থাকা।
যারা সত্যকে ভালোবাসে, তাদের কাজ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সত্য এখন শুধু তথ্য নয়, সত্য এখন এক ধরনের প্রতিরোধ—ফেক নিউজ, বিভ্রান্তি ও ডিজিটাল দানবের বিরুদ্ধে।
শীমুল চৌধুরী: লেখক, নির্মাতা, সাংবাদিক