ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫

২৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ১২ সফর ১৪৪৭

আমি থেকেই আমরা

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২৫

মো. ইসহাক ফারুকী

প্রকাশ: ১৪:৪৭, ৭ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১৪:৪৮, ৭ আগস্ট ২০২৫

আমি থেকেই আমরা

ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ৯ আগস্ট। এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আদিবাসী জনগণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: অধিকার রক্ষা, ভবিষ্যৎ গঠন’। এর সঙ্গে স্ব-যোগাযোগের সম্পর্ক কী? আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরার গুরুত্ব দিতে স্ব-যোগাযোগের ভূমিকা কী? কীভাবে স্ব-যোগাযোগের মাধ্যমে আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরা যাবে? সেই বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলবো আজ।

১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্ব আদিবাসী দিবসটি পালনে ৪৯/২১৪ বিধিমালায় স্বীকৃতি পায়। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আদিবাসী জাতিসত্ত্বার আত্ম-পরিচয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অধিকার সংরক্ষণের জন্য আদিবাসী ও ট্রাইবেল জনগোষ্ঠি কনভেনশন-১৯৫৭(১০৭) ও পুনসংস্করণ আদিবাসী ও ট্রাইবেল জনগোষ্ঠি কনভেনশন-১৯৮৯(১৬৯) দুটি ধারা গৃহীত হয়। কিন্তু আজও অনেক জায়গায় অনেকভাবেই আদিবাসীদের আত্ম-পরিচয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অধিকার সংরক্ষণ হচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশেও একসময়কার আদিবাসী নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর উত্তরপুরুষরা উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তকমা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বর্তমানে চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, গারো/আ·চিক, ওঁরাও, তঞ্চ্যঙ্গা, মুরং বা ম্রো, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খুমি, লুসাই, কোচ, ডালু, কুকি, রাখাইন, মণিপুরী, হাজং, খাসিয়া বা খাসি, মং, বর্মন, পাহাড়ি, মালপাহাড়ি, মুন্ডারি, ভূমিজ, কোল, কন্দ, পাঙন, বানাই, পাহান, কুর্মি, ধুমা, মালো, মেচ, মুসহর, কড়া, নাইয়া, সেন্দুজ বা সেংমাই, লাওরা, রাজবংশী, শিং (গঞ্জু), পত্র, গণ্ড, বাগদী, ভিল, টিপরা, বনজোগী, হদি, খারিয়া/খাড়িয়া, বেদিয়া মাহাতো, রাজোয়ার, কর্মকার, তেলী, তুরী, ভুইমালী, মাহালী, খারওয়ার/খেড়োয়ার, কোরা, গোর্খা জনগোষ্ঠীর বসবাস। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি), কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়নসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, পটুয়াখালি, বরগুনা, গাজীপুর জেলায় তাদের অবস্থান।

বিশ্বব্যাপী আদিবাসী জনগণ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার, অঞ্চল বা টেরিটরির অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতি দাবীতে দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু তাদের নিজের অধিকারের লড়াই পুরো পুরোনো। এই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে স্ব-যোগাযোগ হতে পারে একটি কৌশল বা পদ্ধতি।

এবারের প্রতিপাদ্যে আদিবাসী জনগণের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে (এআই) যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। আদিবাসীরাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন?

স্ব-যোগাযোগ হলো নিজের চিন্তা, অনুভব ও উপলব্ধির সঙ্গে নিজেরই বোঝাপড়া ও কথোপকথন। যখন আদিবাসী জনগণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়, তখন তাদের প্রয়োজন হয়— নিজস্ব পরিচয়, ভাষা, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা; নিজস্ব জ্ঞানভিত্তিকে প্রযুক্তির ভাষায় অনুবাদ করার সক্ষমতা অর্জন করা; আমি কে?— এই প্রশ্নের উত্তর নিজের কাছেই বারবার খোঁজা- এই নিজস্ব ভাবনার চর্চা ও বোঝাপড়াই স্ব-যোগাযোগ।

স্ব-যোগাযোগ আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরতে বেশ বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন- নিজের ভাষা, গল্প, গান, আচার ও রীতির প্রতি গর্ববোধ জাগাতে এবং নিজের বিশ্বাস ও জ্ঞানের ভাণ্ডারকে প্রযুক্তি ও মূলধারার মধ্যে উপস্থাপন করার মানসিক প্রস্তুতি তৈরি করতে আত্মপরিচয়ের ভিত্তি গড়ে তোলা; বাইরের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে নিজস্ব মানদণ্ডে সংস্কৃতি বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া সচল করতে এবং আমাদের কাহিনী আমরা বলব- এই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সংস্কৃতির নিজস্ব মানদণ্ড নির্ধারণে সহায়তা করা; ভাষা, গান, হস্তশিল্প, লোকজ চিকিৎসা ইত্যাদিকে নিজস্বভাবে নথিবদ্ধ করার প্রেরণা পেতে এবং এআই-এর ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আদিবাসী ভাষায় কন্টেন্ট তৈরির চর্চা বাড়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বতন্ত্র পরিচয় সুরক্ষার পথ তৈরি করা।

আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরতে স্ব-যোগাযোগ—

আত্ম-নিবিড় চর্চা: ব্যক্তিগত ডায়েরি লেখা, স্মৃতিচারণ, পারিবারিক ইতিহাস রেকর্ড; নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তা করা ও প্রশ্ন তোলা।

নিজস্ব ভাষায় চিন্তা ও সৃজনশীলতা চর্চা: মাতৃভাষায় কবিতা, গল্প লেখা ও গল্প বলা; লোকগান ও নাচ-গানের অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মপরিচয় জাগানো।

যোগাযোগের কৌশল হিসেবে গল্প বলা চর্চা: বয়োজ্যেষ্ঠদের অভিজ্ঞতা শোনা ও পুনরায় অন্যকে বলা; নিজ সম্প্রদায়ের সমস্যা, সংগ্রাম ও অর্জন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তা উপস্থাপন করা।

স্ব-যোগাযোগকে দলীয় চর্চায় রূপান্তর: বালক/বালিকা ক্লাব, সাংস্কৃতিক মঞ্চ, যুবকদের নিয়ে আইডিয়া চর্চার কর্মশালা; নিজের গল্প নিজে বলি- ভিত্তিক ভিডিও তৈরির ওয়ার্কশপ।

এআই বা প্রযুক্তির ব্যবহারকে সহায়ক হিসেবে গ্রহণ: এআই ব্যবহার করে নিজস্ব ভাষায় কনটেন্ট তৈরি ও সংরক্ষণ; স্ব-পরিচয়ভিত্তিক শব্দভাণ্ডার ও সাংস্কৃতিক তথ্য ডেটাবেজ নির্মাণ।

অন্যের ওপর ভরসা না করে নিজের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখে নিজস্ব উদ্যোগেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তাই আজ থেকে এখনি বলতে হবে- আমি আদিবাসী। আমার গল্প আমি বলি, আমি নিজেকে পরিবর্তন করি, আমি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করি, আমার অর্জন আমাদের অর্জন। কারণ আমি থেকেই আমরা।

লেখক: কবি, লেখক, সাংবাদিক, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, উন্নয়ন কর্মী এবং আহ্বায়ক, ইন্ট্রাপারসোনাল কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক (আইসিএন)।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন