শিরোনাম
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১:১২, ৭ আগস্ট ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
বুধবার (৬ আগস্ট) ভোরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাইয়ারপুর ইউনিয়নের চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজারের কাছাকাছি এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয় বাহারদের বহনকারী মাইক্রোবাস। মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে রাজধানীর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রবাসী বাহারকে নিয়ে লক্ষ্মীপুরে ফিরছিলেন পরিবারের ১১ সদস্য। কিন্তু বাড়ি পৌঁছানোর আগেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইক্রোবাসটি রাস্তার পাশে প্রায় ৩০ মিটার গভীর একটি খালে পড়ে যায়। মুহূর্তেই প্রবাসফেরত আনন্দযাত্রা রূপ নেয় ভয়াবহ মৃত্যুযাত্রায়।
দুর্ঘটনায় বাহার বেঁচে যান। মারা যান তার স্ত্রী কবিতা আক্তার (৩০), দুই বছরের কন্যা মীম, মা খুরশিদা বেগম (৫৫), নানি ফয়জুন নেছা (৮০), ভাবি লাবনী বেগম (৩০), ভাতিজি রেশমা আক্তার (১০) ও লাবনীর মেয়ে লামিয়া আক্তার (৯)। মাইক্রোবাসটি প্রথমে কিছুক্ষণ পানিতে ভেসে থাকলেও পরে ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়। চালকের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা এবং অবহেলা এ দুর্ঘটনার পেছনে বড় কারণ বলে অভিযোগ করছেন বেঁচে ফেরা স্বজনেরা।
চৌপল্লী গ্রামে বুধবার সকালে যখন সাতটি মরদেহ একসঙ্গে এসে পৌঁছে, তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের জন্ম নেয়। বাড়ির ছোট উঠানে সারি সারি লাশ শায়িত। পাশে শোকাচ্ছন্ন স্বজনদের কান্নার রোল। গোসলের জন্য টানানো হয়েছে শামিয়ানা, উঠানে বসানো হয়েছে চেয়ার। কিন্তু এই সমস্ত আয়োজন যেন নিঃশব্দে বিলাপের এক অব্যক্ত ভাষা বহন করছিল। চারপাশে উপস্থিত গ্রামবাসীর চোখেও ছিল একই শোক, এক অপূরণীয় ক্ষতি।
প্রিয়জনদের কবরস্থানে শায়িত করার সেই মুহূর্তে বাহার যেন আর্তনাদ করেই উঠলেন, আমি ফিরছিলাম সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতে, অথচ ফিরে পেলাম সাতটা লাশ। আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচব?
তার কথা থেমে থেমে কেঁপে উঠছিল। একটু পর বললেন, গাড়িতে বসে আমরা কত হাসিঠাট্টা করছিলাম। আম্মা বলছিলেন, তোর জন্য কত অপেক্ষা করছি, বাপ। কথাটা শেষ হইতে পারে নাই, হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। তারপর আর কিছু মনে নাই। গাড়ি খালের পানিতে ভাসতেছিল।
এ ঘটনার জন্য গাড়িচালক রাসেলকে দায়ী করছেন বাহার ও তার স্বজনেরা। বাহার বলেন, কুমিল্লায়ও একবার দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিল গাড়ি। তখনই বলেছিলাম, দরকার হলে ঘুমিয়ে নিন। কিন্তু চালক শোনেননি। শেষে যেটা ঘটল, সে নিজেই জানালা দিয়ে বের হয়ে পালিয়েছে, আর আমাদের আটকে রেখে গেছে মৃত্যুর মধ্যে।
এই দুর্ঘটনায় বেঁচে গেছেন বাহার, তার বাবা আব্দুর রহিম, শ্বশুর ইস্কান্দার মীর্জা, ভাবি সুইটি আক্তার ও শ্যালক রিয়াজ হোসেন। কিন্তু তারা কেউই সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি থেকে বের হতে পারছেন না। বাহারের বাবা আব্দুর রহিম শোকে কাতর হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। একদিকে স্ত্রীর মৃত্যু, অন্যদিকে শাশুড়ি, দুই পুত্রবধূ, তিন নাতনির আকস্মিক প্রাণহানি তাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী, শ্বাশুড়ি, তিন নাতনি ও দুই পুত্রবধূ পানিতে ডুবে মারা গেছে। চালক ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে আমাদেরকে পানিতে ডুবে রেখে পালিয়ে গেছে। আমরা কয়েকজন বের হতে পেরেছি। কিন্তু বাকিদের উদ্ধার করতে পারিনি।
তিনি আরো বলেন, আমার দুই ছেলে বিদেশ থেকে আসবে। তারা এলে আমরা এ ঘটনায় মামলা করব। চালককে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।
বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে নিহতদের কবরের সামনে আহাজারি করছিলেন লিপি আক্তার নামে এক স্বজন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি ডাকছিলেন আদরের ছোট বোন ও ভাগনিদের। কেউই তাকে থামাতে পারছিল না। চারদিকজুড়ে শোক আর কান্না।
দুর্ঘটনার পর থেকেই চালক রাসেল পলাতক। চন্দ্রগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন বলেন, পরিবার যদি মামলা না করে, তাহলে আমরা মামলা করব। চালককে আটকের চেষ্টা চলছে।
বুধবার বিকেলে নিহতদের জানাজা শেষে চৌপল্লী গ্রামের কাশারি বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে ছয়জনকে পাশাপাশি দাফন করা হয়। বৃদ্ধা ফয়জুন নেছার মরদেহ নেওয়া হয় তার নিজ বাড়ি হাজিরপাড়া গ্রামে।
চৌপল্লী গ্রামের ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, একটি পরিবার পুরোপুরি শেষ হয়ে গেল। এই ক্ষতি কারো পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। এমন দৃশ্য এর আগে কখনো দেখিনি। পুরো গ্রাম আজ গভীর শোকস্তব্ধ।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ