শিরোনাম
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪:০৫, ২৬ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৪:০৬, ২৬ মে ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
নাসের মেডিক্যাল কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আহমদ আল-ফাররা সিএনএনকে বলেন, ডা. নাজ্জার তার সন্তানদের হারিয়েও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে তিনি স্বামী ও বেঁচে যাওয়া একমাত্র সন্তানকে দেখতে যাচ্ছেন।
গত শুক্রবার নাজ্জার তার ১০ সন্তানকে বাড়িতে রেখে নাসের মেডিক্যাল কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তার কয়েক ঘণ্টা বাদে সাত শিশুর দেহ হাসপাতালে আনা হয়; যাদের বেশিরভাগই মারাত্মকভাবে পুড়ে গিয়েছিল।
গাজা সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ডা. নাজ্জারের বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার এই সাত শিশু প্রাণ হারায়। এই চিকিৎসকের সাত মাস বয়সী ও ১২ বছর বয়সী আরেক সন্তান এখনো নিখোঁজ রয়েছে। তারাও মারা গেছে বলে কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে।
সিএনএন লিখেছে, তার ১০ সন্তানের মধ্যে ১১ বছর বয়সী আদমই একমাত্র বেঁচে গেছে। ডা. নাজ্জারের স্বামী হামদিও একজন চিকিৎসক, যিনি এই হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মুনির আল-বুরশ এক্স পোস্টে বলেন, ডা. নাজ্জারের স্বামী বাড়ি ফেরার পরপরই তাদের বাড়িতে হামলা হয়। তাদের নয় সন্তান নিহত হয়েছে: ইয়াহিয়া, রাকান, রাসলান, জিবরান, হাওয়া, রিভাল, সায়দেন, লুকমান ও সিদরা। এটিই গাজায় আমাদের চিকিৎসাকর্মীদের বাস্তবতা। এই বেদনা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। গাজায় কেবল স্বাস্থ্যকর্মীদের নিশানা করা হচ্ছে না- ইসরায়েলের আগ্রাসন আরও ভয়াবহ, পুরো পরিবারকেই শেষ করে দিচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইউসুফ আবু আল-রিশ বলেন, ডা. নাজ্জার তার সন্তানদের বাড়িতে রেখে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিলেন। তিনি সেই সব অসুস্থ শিশুদের দেখভাল করেন, যাদের নাসের হাসপাতাল ছাড়া আর কোনো আশ্রয় নেই।
রিশ বলেন, তিনি হাসপাতালে পৌঁছানোর পর নাজ্জারকে ‘দৃঢ়, শান্ত, ধৈর্যশীল ও স্থির’ দেখেছেন, যার চোখে ছিল বাস্তবতা মেনে নেওয়ার দৃষ্টি। তার কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল কেবল আল্লাহর জিকির ও ক্ষমা প্রার্থনার ধ্বনি।
৩৮ বছর বয়সী ডা. নাজ্জার একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, কিন্তু গাজার বেশিরভাগ চিকিৎসকের মতোই ইসরায়েলের প্রচণ্ড আক্রমণের সময় তিনি জরুরি বিভাগে কাজ করছেন।
সিভিল ডিফেন্স ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজার দক্ষিণে খান ইউনিসের একটি এলাকায় তাদের পারিবারিক বাড়িটি ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
সিএনএনের অনুরোধের জবাবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, খান ইউনিস এলাকায় আইডিএফ সেনাদের কাছাকাছি স্থাপনা থেকে কাজ করছে- এমন বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো হয়েছে।
বেসামরিক নাগরিক হতাহতের যে দাবি উঠেছে তা পর্যালোচনা করার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
আইডিএফের এক বিবৃতি অনুযায়ী, ইসরায়েলি সামরিকপ্রধান এয়াল জামির রবিবার খান ইউনিসে গিয়েছিলেন।
হামাসের খান ইউনিস ব্রিগেডকে ধ্বংস করার নির্দেশনা দিয়ে সেনাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, হামাস চরম চাপের মধ্যে রয়েছে- তারা বেশিরভাগ সম্পদ এবং কমান্ড ও কন্ট্রোল ক্ষমতা হারিয়েছে। জিম্মিদের বাড়ি ফেরানো, হামাসকে ধ্বংস করা এবং এর শাসন ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার জন্য আমরা সব ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করব।
গাজা সিভিল ডিফেন্স ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, মেডিক্যাল কর্মীরা একজন আহত ব্যক্তিকে স্ট্রেচারে, অন্যরা বাড়ির আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। তারা ধ্বংসস্তূপ থেকে পুড়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি শিশুর দেহ উদ্ধার করে সাদা কাপড়ে মুড়ে দেয়।
ঘটনার বর্ণনায় আহত হামদির ভাতিজি ডা. সাহার আল-নাজ্জার জানান, ৩৮ বছর বয়সী হামদি তার স্ত্রীকে হাসপাতালে রেখে বাচ্চাদের জন্য খাবার আনতে গিয়েছিলেন। ফেরার পর তিনি বাড়িতে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ দেখেন; যা অবিস্ফোরিত ছিল। বাচ্চাদের উদ্ধারে তিনি ভেতরে ছুটে গেলে ইসরায়েলি দ্বিতীয় আক্রমণের শিকার হন।
ডা. সাহার বলেন, চাচা হামদিকে উদ্ধার করতে গিয়ে আমার বাবা রাস্তায় আদমকে পান এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। বাকি শিশুরা সবাই পুড়ে কালো হয়ে যায়, চাচা হামদিকে উদ্ধার করে সিভিল ডিফেন্স।
দক্ষিণ গাজায় এখন নতুন করে হামলা চলছে। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি) রবিবার জানায়, শনিবার খান ইউনিসে তাদের দুই কর্মীর বাসায় হামলায় তারা নিহত হয়েছেন। এই হামলা সম্পর্কে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বক্তব্য জানতে সিএনএন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে।
তাদের মৃত্যু গাজায় বেসামরিক অসহনীয় হতাহতেরই ইঙ্গিত দেয়, বলছে আইসিআরসি।
সাহার রবিবার বলেন, শিশুকন্যা সিদরার জন্য রাখা বুকের দুধের শেষ বোতল দেখিয়ে এদিন ডা. নাজ্জার ভেঙে পড়েন। সিদরার দেহ এখনো উদ্ধার হয়নি। আজ তিনি আমাকে বললেন, সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর কথা ভেবে তার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। প্রতিদিন কাজের ফাঁকে সিদরার জন্য বোতলে দুধ রাখতেন ডা. নাজ্জার। তিনি আজ আমাকে শেষ বোতলটি দেখান, যা তিনি তার মেয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।
ডা. সাহার বলেন, ডা. নাজ্জার এখন ঠিকমতো কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না। আপনি যদি তার মুখ দেখতেন, তাহলে তার ব্যথা বুঝতে পারতেন। তিনি কেবল তার ছেলে ও স্বামীর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছেন।
বেঁচে যাওয়া একমাত্র শিশু আদমকে যখন অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করা হয়, তখন সে বোন হাওয়ার নাম ধরে চিৎকার করে বলে, গাছে রক্ত লেগেছে।
সিএনএন লিখেছে, আদম একটি হাতে মারাত্মক আঘাত পেয়েছে, কয়েক দিনের মধ্যে তার আরেকটি অস্ত্রোপচার করতে হবে। তার বাবা হামদি এখনো গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন।
ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে অবস্থিত ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বার্তায় ডা. নাজ্জারকে সমবেদনা জানিয়ে বলেছে, তাকে সেই অবিচল ফিলিস্তিনি নারী ও মহান চিকিৎসক হিসেবে বিবেচনা করা হবে, যিনি নিজের বেদনাকে চেপে রেখে অন্যকে সেরে উঠতে সহায়তা করেছেন।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ