শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬:৩৬, ২৪ মে ২০২৫ | আপডেট: ২১:৩২, ২৪ মে ২০২৫
করিডর হলো একটি নির্দিষ্ট পথ বা রুট যা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিরাপদে ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণত আন্তর্জাতিক বা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়। মোটা দাগে করিডরকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন বাণিজ্যিক করিডর, মানবিক করিডর এবং সামরিক করিডর। দুটি অঞ্চলের মধ্যে অবাধে পণ্য ও বাণিজ্য সরবরাহের জন্য বাণিজ্যিক করিডর নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন চীন, পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর। কোন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় খাদ্য ও সুধ বা ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডর তৈরি করা হয়।
সিরিয়া এবং ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধে মানবিক করিডর স্থাপনের নজির রয়েছে। অন্যদিকে সামরিক করিডর হলো এমন নির্দিষ্ট পথ যা সামরিক বাহিনীর অস্ত্র সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য নিরাপদে ব্যবহৃত হয়। যেমন ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সৌদি আরব থেকে ইরাক ও কুয়েত সীমান্তের সড়ক পথগুলো যুক্তরাষ্ট্র সামরিক করিডর হিসেবে ব্যবহার করেছে।
মানবিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক করিডর ছাড়াও অন্যান্য ধরনের বেশকিছু করিডর রয়েছে। যেমন বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য পরিবেশগত করিডর, রেল ও সড়ক যোগাযোগের জন্য পরিবহন করিডর, তেল গ্যাস বা বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জ্বালানি বা শক্তি করিডর, ফাইবার অপটিক কেবল সাইবার নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল তথ্য করিডর এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ ও পর্যটন উন্নয়নের জন্য শিক্ষা বা সাংস্কৃতিক করিডর উল্লেখযোগ্য। কোন সংঘাতপূর্ণ বা দুর্যোগ আক্রান্ত এলাকায় খাদ্য, ওষুধ, পানি বা চিকিৎসা সরঞ্জামের মতো জরুরি ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডর ব্যবহৃত হয়।
এটি বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষা এবং মানবিক সংকট মোকাবেলার লক্ষ্যে স্থাপিত হয়। কখনো কখনো এই করিডর বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। মানবিক করিডর সাধারণত জাতিসংঘ বা অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এবং সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে কার্যকর হয়। মানবিক করিডরের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ত্রাণ সরবরাহ, বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা, মানবাধিকার রক্ষা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সংকটগ্রস্ত জনগণ যেন দুর্ভিক্ষ, অনাহার বা স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখী না হয় সেই লক্ষ্যে মানবিক করিডর স্থাপন করা হয়। অবরুদ্ধ বা সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার আগে বা পরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন নিশ্চিত করাও একটি উদ্দেশ্য। সেই সাথে ত্রাণ বিতরণে কোন পক্ষপাতিত্ব ছাড়া সকল পক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যক্তির কাছে সহায়তা পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
মানবিক করিডরের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো করিডরে সামরিক কার্যক্রম বা অস্ত্রের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা। করিডরের ত্রাণ পরিবহন বা নাগরিকদের স্থানান্তরের সময় যেন নতুন করে কোন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি না হয় সে বিষয়েও খেয়াল রাখা। সাধারণত জাতিসংঘ বা রেডক্রস এর মত নিরপেক্ষ সংস্থাগুলো এটি পরিচালনা করে। তাই এমন কোন বিতর্কিত পক্ষ বা সংস্থাকে মানবিক করিডরের প্রবেশাধিকার না দেওয়া যাতে করে নতুন করে সংঘাত তৈরি হয়। কারণ এই ব্যবস্থার অন্যতম শর্তই হলো যুদ্ধবিরতি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে করিডরকে হামলা মুক্ত রাখা।
মানবিক করিডর আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে পরিচালিত হয়। যা জেনেভা কনভেনশন এবং এর অতিরিক্ত প্রোটোকল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইন অনুযায়ী ত্রাণকর্মী ও কনভয়ের উপর হামলা করা যুদ্ধপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কাগজে কলমে মানবিক করিডরকে বিভিন্ন সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও অনেক সময় ত্রাণ সামগ্রী সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে যেতে পারে। ত্রাণ বিতরণে কিছু গোষ্ঠী বঞ্চিত হতে পারে যা আরো বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী রাখাইনে প্রায় ২০লাখ মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি মানবিক করিডর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। যাতে ত্রাণ সামগ্রী রাখাইনের বেসামরিক জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়।
বাংলাদেশ সরকার মানবিক করিডরের বিষয়ে যে আলোচনা করেছে, সেই আলোচনার চুক্তির শর্তগুলো বিস্তারিত জনসম্মুখে প্রকাশ না করায় রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্তের ব্যাপারে জানা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ত্রাণ সরবরাহ শুধুমাত্র জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। ত্রাণ যেন সরাসরি রাখাইনের নাজুক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় এবং আরাকান আর্মি বা মিয়ানমার জানতার মতো কোন সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেন এটি দখল করতে না পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো করিডর যেন রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে আরো জটিল না করে বা বাংলাদেশের নিরাপত্তার ঝুঁকি না বাড়ায়। সকল জাতিগত গোষ্ঠী বিশেষ করে রোহিঙ্গা রাখাইন এবং অন্যান্য সংখ্যালগুদের মধ্যে ন্যায্যভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। মানবিক করিডর বাস্তবায়নের চুক্তির শর্ত হিসেবে এসব বিষয়ে আলোচনা করা হলেও বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। রাখাইনের বেশিরভাগ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। যারা একটি রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র গোষ্ঠী সে কারণে ত্রাণ সামগ্রী তাদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
করিডরের ফলে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এমনকি বিগত কয়েক মাসে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশও করেছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মূলত একটি আন্তর্জাতিক কৌশলের অংশ। যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই করিডর ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র চায় আরাকান আর্মিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করতে। কারণ চীন ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের জানতা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে রাখাইনকে চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভুক্ত করেছে। যার ফলে চীন এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্র বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে বঙ্গোপসাগরসহ ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে এখানে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাখাইনে অস্থীতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে চীনের প্রভাবকে ভারসাম্যহীন করার চেষ্টা করতে পারে।
জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাখাইনের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করেও সহায়তা পাঠাতে পারে। কিন্তু তারা করিডর ব্যবহারের পন্থা বেছে নিয়েছে। কারণ মানবিক করিডর একটি ছদ্দবেশী কৌশল হতে পারে। যাতে ভবিষ্যতে এখানে পরিস্থিতি আরো জটিল হলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কেউ যেন জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে না পারে। উল্টো বাংলাদেশ, ভারত, চীন বা অন্য কোন পক্ষের উপর যেন দায় চাপানো যায়। জাতিসংঘের নিরপেক্ষতার আড়ালে এই ধরনের আন্তর্জাতিক চালবাজি বিশ্বের যেকোনো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলেই একটি সাধারণ ঘটনা। এভাবেই বিশ্ব রাজনীতির খেলায় মানবিক সাহায্য নামের আড়ালে গভীর কৌশল লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের জন্য মানবিক করিডর একটি জটিল দ্বিধার জায়গা। একদিকে করিডরের সম্মতি দিলে হয়তো দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। আবার অন্যদিকে করিডরে অসম্মতি জানালেও আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে দায়ী করে রোহিঙ্গা সংকটকে আরো ঘোলাটে করতে পারে। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে আরো হুমকির মুখে ঠেলে দিবে।
এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী বোঝা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা ইস্যু। যতদিন এই সমস্যার সমাধান না হচ্ছে ততদিন বাংলাদেশ পুরোপুরি নিরাপদ নয়। এখন করিডর ইস্যুতে বাংলাদেশ যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, ভবিষ্যতে সমস্যা শুধু জটিলই হবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য বহুদিন থেকেই নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে হটিয়ে রাখাইন রাজ্যের কর্তৃত্ব নিয়েছে। এরপর থেকেই বাংলাদেশের সীমান্তে রাখাইনে একটি স্বাধীন দেশ গড়ে ওঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ