ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০১ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

জন্ম বরিশালে, কাঁপিয়েছেন আন্ডারওয়ার্ল্ড

যেভাবে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন সুব্রত বাইন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫:৫২, ২৭ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৭:১৯, ২৭ মে ২০২৫

যেভাবে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন সুব্রত বাইন

ঢাকার অপরাধজগতের দীর্ঘদিনের ত্রাস, কথিত ‘সেভেন স্টার’ বাহিনীর প্রধান সুব্রত বাইনকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। মঙ্গলবার (২৭ মে) ভোরে কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর এক অভিযানে সহযোগীসহ তাকে আটক করা হয়। বিষয়টি সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আজই সংবাদ সম্মেলন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

সুব্রতর নামে ৩০টিরও অধিক খুনের মামলা রয়েছে, যার প্রায় সবগুলোতেই এই সন্ত্রাসী সাজাপ্রাপ্ত, এছাড়াও অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজি সহ প্রায় ১০০ মামলার আসামীও তিনি। ২০০১ সালে পুরস্কার ঘোষিত এই শীর্ষ সন্ত্রাসী আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড কর্ণার নোটিশ প্রাপ্ত।

সুব্রত বাইনের উত্থান, পালিয়ে থাকা আর প্রতিশোধের গল্প

১৯৬৭ সালের ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে জন্ম নেওয়া সেই শিশুটির নাম ছিল ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। কেউ বলেন জন্ম বরিশালে। বড় হয়ে যিনি হয়ে উঠেন ঢাকার অপরাধজগতের ত্রাস, কথিত 'সেভেন স্টার' বাহিনীর প্রধান, বাংলাদেশের প্রথম সারির শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একজন। কিন্তু কে ভাবতে পেরেছিল যে বরিশালের জোবারপাড় গ্রামের এক সাধারণ এনজিও গাড়িচালকের সন্তান একদিন আন্ডারওয়ার্ল্ডের রাজা হবে?

সুব্রতের শৈশব কেটেছিল বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন স্কুলে। হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন না। ফলে পরিবার তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ভর্তি করা হয় শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখান থেকেই এসএসসি পাস করেন। এরপর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়েই ঘটে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা—সেখানে এক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে পরিচয় হয়, আর সেই সূত্রেই বইয়ের বদলে হাতে ওঠে অস্ত্র।

অস্ত্র হাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব

নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ঢাকার মগবাজারে এক সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে তোলেন সুব্রত। ১৯৯৩ সালে মধুবাজারে এক সবজিবিক্রেতা হত্যাকাণ্ডে তাঁর নাম পুলিশের খাতায় ওঠে। এরপরই শুরু হয় সুব্রতের সংবাদ শিরোনামে উঠে আসা। মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণকাজে চাঁদাবাজির ঘটনায় গোলাগুলি হয়—যা তাঁকে 'তারকা সন্ত্রাসী'র তকমা দেয়।

একসময় সেই সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতা হয়ে যান সুব্রত। সেই পরিচয়েই একের পর এক চাঁদাবাজির অভিযোগ। পাশাপাশি রাজনৈতিক যোগাযোগও গড়ে তোলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির হয়ে কাজ করেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, এমনকি তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বিএনপির শীর্ষ নেতারাও হাজির হন।

বড় বড় খুনের ঘটনায় জড়িত সুব্রত

১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিনজনকে খুন করে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি। মগবাজার, রমনা, কারওয়ান বাজারসহ আশপাশের এলাকায় প্রতিদিন গুলির শব্দ যেন সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছিল। পুলিশও ঘটনার ভয়াবহতা না বুঝলে সাড়া দিত না। সুব্রতের বিরুদ্ধে এ সময় ৩০টির বেশি মামলা ছিল, এর মধ্যে ছিল আজীবন কারাদণ্ডের রায়ও।

প্রেম, বিয়ে আর বিশ্বাসঘাতকতা

জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর স্ত্রী লুসি প্রেমে পড়ে যান আরেক সন্ত্রাসীর সঙ্গে। ঘটনা জানার পর সুব্রত নিজেই তাঁদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। পরে বিউটি নামের এক নারীকে বিয়ে করলেও সেই সম্পর্কও ভেঙে যায়।

বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধী

২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার তাঁকে সবচেয়ে বিপজ্জনক সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট জারি করে। এর পরই কলকাতায় পালিয়ে যান সুব্রত। নদীয়ায় বিয়ে করেন, কিনে ফেলেন জমি ও বাড়ি। ভারতীয় নাগরিকত্বের কাগজও বানিয়ে ফেলেন। তবু ২০০৮ সালে কলকাতায় ধরা পড়েন। জামিনে বেরিয়ে যান দুবাই, আবার ফিরে কলকাতায় এক নায়িকার কাছে চাঁদা দাবি করেন। ফোন কল ট্র্যাক করে পুলিশ আবার ধাওয়া করে।

দুঃসাহসিক পালানোর ঘটনা

২০০৯ সালে সুব্রত পালিয়ে যান নেপালে। সীমান্ত শহর কাঁকরভিটায় তাঁকে ধরে ফেলে নেপালি পুলিশ। রাখা হয় ঝুমকা কারাগারে। কিন্তু এখানেও থেমে থাকেননি। ২০১২ সালে ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে পালান সেই কারাগার থেকে! কয়েকদিন পর কলকাতার বউবাজার থেকে আবার ধরা পড়েন। এরপর থেকে তিনি ভারতের জেলেই আছেন।

কারাগার থেকেও নিয়ন্ত্রণ করতেন অপরাধজগত

জেলে থেকেও ঢাকার ঠিকাদারি ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও টাকা আদায়ের কাজ করতেন সুব্রত। নদীয়ায় কিনে ফেলেন ৫০ বিঘা জমি ও বাগানবাড়ি। কলকাতা ও ঢাকার ব্যবসায়ীদের ‘মধ্যস্থ’ হিসেবে কাজ করতেন তিনি। তাঁর ভয়ংকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সীমান্ত ছাড়িয়ে।

পরিবারের শেষ আশ্রয় ও পরিণতি

মগবাজারের সেই কুখ্যাত বাড়ি ছেড়ে পরিবারের সদস্যরা এখন গাজীপুরের পুবাইলে বসবাস করেন। সুব্রতের বাবা-মা এখনও জীবিত, ভাই-বোনরা ছড়িয়ে আছেন নানা পেশায়। কিন্তু সুব্রতের জীবন এখনো এক দীর্ঘ অন্ধকার অধ্যায়ের মধ্যেই বন্দী।

এই গল্প কী শেখায়?

সুব্রত বাইনের জীবন একটি নির্মম বাস্তবতা। সমাজের ভাঙা কাঠামো, রাজনৈতিক আশ্রয়, এবং অপরাধে প্রশ্রয়ের ফলে একজন সাধারণ ছেলেও হয়ে উঠতে পারে 'গডফাদার'। তবে শেষ পরিণতিতে—পলায়ন, প্রতিশোধ, কারাবাস এবং চিরতরে এক বন্দী জীবনই হয় তার নিয়তি।

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন