ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

১১ বৈশাখ ১৪৩২, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৬

শাসককে প্রশ্ন করলেই কেন চলচ্চিত্রে ‘সেন্সর খড়্গ’

মীর রাকিব হাসান

প্রকাশ: ১৪:১৪, ২২ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ১৬:২৭, ২২ এপ্রিল ২০২৫

শাসককে প্রশ্ন করলেই কেন চলচ্চিত্রে ‘সেন্সর খড়্গ’

সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু মানুষের জীবনচক্র নিয়ে সিনেমা ‘বর্ডার’। এক বছরের বেশি সময় ধরে এই নামেই সিনেমাটির প্রচারণা করে সংশ্লিষ্টরা। মুক্তির আগে বাদ সাধে সেন্সর বোর্ড। নানারকম কাটাছেঁড়ার ফরমায়েশ দেয়। প্রথমেই সেন্সর করে ছবির নাম, বাধ্য হয়ে সংশ্লিষ্টরা নতুন নাম দেয় ‘সুলতানপুর’। নানা বাধা পেরিয়ে ২০২৩ সালে মুক্তি পায় সিনেমাটি।

‘বর্ডার’ নিয়ে সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা বলেছিলেন, ‘ছবিতে খোলাখুলিভাবে ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়টি এসেছে। তা ছাড়া ভিনদেশ থেকে সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশে ঢুকে খুন জখম করার ব্যাপারটিও আছে। ছবিতে একজন গডফাদারকে দেখানো হয়েছে, যার হাতে মন্ত্রী ও এমপি জিম্মি থাকেন।’ বর্ডার কেন্দ্রীক সিনেমাটিতে কোথাও বলা হয়নি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তবে সীমান্তের একটি কল্পিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যা পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে কমবেশি মানুষের কাছে পরিচিত। ‘বর্ডার’ হোক কিংবা ‘গ্যাংস্টার’- পৃথিবীতে এমন বিষয়গুলো নিয়ে কয়েক শত সিনেমা হয়েছে। ভাগ্যিস বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ডের মতো খড়্গ সেসব ছবিতে তেমন একটা পরেনি।

গত বছর সেন্সর বোর্ডের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ নামকরণ করেছে সরকার। ‘বর্ডার’ সিনেমাটি যখন আটকে দেওয়া হয়, তখন ‘সেন্সর বোর্ড’ ছিল। এই বোর্ডের সদস্য ছিলেন অভিনেত্রী অরুনা বিশ্বাস। তিনি বলেছিলেন, ‘সেন্সর বোর্ডে স্বরাষ্ট্র, আইন ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও ছবি দেখেন। এই ছবি দেখে তাঁরা অনেকগুলো জায়গায় অবজারভেশন দিয়েছেন।’

ভাবতে পারেন বাংলাদেশের একটি সিনেমা কত মন্ত্রণালয়কে সন্তুষ্ট করে মুক্তি দিতে হয়! মন্ত্রণালয়কে সন্তুষ্ট করতে এক ধাপ এগিয়ে থাকেন সেন্সর বোর্ডে বসে থাকা চলচ্চিত্রের মানুষরাও। সেন্সর বোর্ড দখল করে বসে থাকা আওয়ামীপন্থী অরুনা বিশ্বাস মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেছিলেন, ‘ছবিটা দেশের জন্য বিপজ্জনক মনে হয়েছে।’ ছবির একাধিক অংশে রিশুট করার জন্য বলা হয়। পরবর্তীতে সেন্সর বোর্ড কর্তাদের তুষ্ট করতে পরিচালক-প্রযোজক কিছু দৃশ্যের কাটছাঁট করেন ও কিছু জায়গায় নতুন করে আবার শুটিংও করেছিলেন। ভাবা যায়, একটা ছবির খরচের খাতা তাহলে কতটা ভারি হলো!

সিনেমা মুক্তির আগে ‘সেন্সর বাঁধা’ নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরে চলছে সেন্সর বোর্ডের ঔপনিবেশিক মেজাজ। আইন করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়, কোন কোন চিত্র জনগণ দেখবে। তবে সেন্সরবোর্ড কোন ধরণের চিত্রকে হুমকিস্বরূপ মনে করে এবং তা কীভাবে চলচ্চিত্র উৎপাদনের গুণমানকে প্রভাবিত করে?

২০০৯ সালে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়বস্তু থাকার কারণে এনামুল হক নির্ঝরের রাজনৈতিক স্যাটায়ার ‘নমুনা’ ছবিটি আটকে দেওয়া হয়। জানা যায়, চলচ্চিত্রটিতে রূপকভাবে একটি ছোট গ্রাম সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে রাজনৈতিক ভূ-দৃশ্যটি তুলে ধরা হয়েছে।

২০১১ সালে দেখা যায়, খলনায়কের গায়ে ‘মুজিব কোট’ পরিধান করানোর দায়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ’ ছবিটিকেও নিষিদ্ধ করা হয়।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ‘নমুনা’, ‘রানা প্লাজা’, ‘অমীমাংসিত’, ‘শনিবার বিকেল’, ‘মেকআপ’, ‘আমার বাইসাইকেল-মর থেংগারি’সহ আটটি ছবি আটকে আছে। কোনো ছবি ১৫ বছরে মুক্তি দিতে পারেননি পরিচালক। সেন্সর প্রথা বিলুপ্ত হয়ে এরই মধ্যে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়েছে। প্রযোজক-পরিচালকেরা অপেক্ষায় আছেন, আটকে থাকা ছবিগুলো এবার মুক্তির অনুমতি পাবে।

বিখ্যাত চলচ্চিত্রকাররা যেভাবে শাসকের প্রতি প্রশ্ন রেখেছেন

তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ-পরবর্তী সমস্যা-পীড়িত পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের ছবিতে সমকালীন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। বর্তমানের গুরুতর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা কখনও তাঁরা তুলে ধরেছেন সরাসরিভাবে (মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’, ওসমান সেমবেনের ‘হাল্লা’); কখনও সমালোচনা করা হয়েছে রূপকের মাধ্যমে (জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’, সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’, আবদার রহমান সিসাকোর ‘বামাকো’) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

সেনেগালের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ওসমান সেমবেনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ছবি, ‘হাল্লা’ (১৯৭৪), সেনেগালের স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসকদের শঠতাপূর্ণ আচরণের নির্দয় সমালোচনা তুলে ধরে। তাই অনেক দৃশ্য বাদ দেওয়ার পরই কেবল ‘হাল্লা’ মুক্তি দিতে দেওয়া হয় সেমবেনকে।

সেন্সর বোর্ডের ঔপনিবেশিক ইতিহাস

সেন্সর বোর্ডের কাঠামো মূলত নির্মিত হয়েছিলো চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য। ১৯১৮ সালে উপমহাদেশে প্রথম ব্রিটিশ সরকার ‘আপত্তিকর চলচ্চিত্রের প্রদর্শন রোধ করতে’ সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট গঠন করে। ১৯২১ সালে নায়ককে ‘গান্ধী টুপি’ পরিধান করানোর জন্য ‘ভক্ত ভিদুর’ চলচ্চিত্রে প্রথম সেন্সর কাঁচি চালানো হয়।

এই আইনেই জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো চলচ্চিত্রকেও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার আরও কিছু ধারা যোগ করে সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩  প্রবর্তন করে। মজার ব্যাপার হলো, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলের এবং পাকিস্তান শাসন আমলের উভয় আইনই এখনো কার্যকর আছে। এগুলোই বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের নির্দেশনাবলীর মূল দলিল গঠন করে।

চলচ্চিত্রের শক্তি

রুশ কবি মায়াকোভস্কি যেমন বলেছিলেন, ‘শিল্পকলায় মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রামের বিবরণই শুধু প্রতিফলিত হয় না, শিল্পকলা মানুষের সংগ্রামে একটি হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে।’ আর রুশ বিপ্লবের পর বিপ্লবী চেতনা সমুন্নত রাখতে লেনিন সেই সময়ের সাংস্কৃতিক কমিশনার লুনাচারস্কিকে বলেছিলেন, সব ধরনের আর্টের মধ্যে চলচ্চিত্রই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার ব্যাপারে চলচ্চিত্রের সক্ষমতা লেনিন অনুধাবন করেছিলেন সঠিকভাবে।

কিউবায় বামপন্থী বিপ্লব সফল হওয়ার পর নতুন সমাজে বৈপ্লবিক চিন্তা শক্তিশালী করতে দ্রুত একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেখানে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন চিন্তাশীল চলচ্চিত্র।

ষাটের দশকে বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিবাদের ফলে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল সেটি তুলে ধরার চেষ্টা তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। হয়তো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের নিয়ন্ত্রণের কথা চিন্তা করেই চলচ্চিত্রকাররা এতে অনাগ্রহী ছিলেন। তখন সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সাহসী সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছিল একমাত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতেই। পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালকরা শাসককে প্রশ্ন করার সিনেমা খুবই কম তুলে ধরতে পেরেছেন।

যে অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রে প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র-ভাষা ব্যবহার এবং রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেও প্রায়ই সমকালীন সময় সরাসরি তুলে ধরা হয়নি। সেখানে রাজনৈতিক সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে পরোক্ষভাবে, অতীতের কোনো সময় তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।

উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে সামাজিক বক্তব্যধর্মী ছবি আমাদের দেশে হয়তো নিয়মিত নির্মিত হত। এমন ছবি নির্মাণের অনুকূল পরিবেশ যদি না পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে কীভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করা যায়, রূপকধর্মী ‘জীবন থেকে নেয়া’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে জহির রায়হান বহু বছর আগেই তা স্পষ্ট করেছেন। সেই উদাহরণ বর্তমান সময়ের রাজনীতিমনস্ক পরিচালকদের অনুপ্রেরণা যোগাবে- এমনটাই স্বাভাবিক। তবে এমন চলচ্চিত্র নির্মাণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারদের যথেষ্ট আগ্রহ থাকাও দরকার।

দর্শকের মনোযোগ কোন দিকে

বিনোদননির্ভর বাণিজ্যিক ছবিসমূহে সমাজের জটিল সমস্যাগুলি থেকে দর্শকের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখা হয়। আনন্দ প্রদানই এই ধরনের ছবির মূল লক্ষ্য, দর্শককে বিচলিত বা ক্ষুব্ধ করা নয়। সামাজিক সমস্যাসমূহ কখনও সেখানে উপস্থাপিত হলেও আনন্দদায়ক উপাদানে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে দর্শকমনে তা যথেষ্ট অস্বস্তি তৈরি করতে পারে না। আবার কখনও শক্তিশালী কোনো নায়কের অশুভ শক্তিকে পরাজিত করার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় সামাজিক সমস্যার অবাস্তব সমাধান। প্রায় সব সরকারই উৎসাহ দেয় এমন সিনেমা নির্মাণে। কিছু সরকার একধাপ এগিয়ে ‘প্রপাগান্ডা’ সিনেমা নির্মাণ করেন। এর মধ্যে বলিউডের ‘অ্যাকসিডেন্ট অর কন্সরিরেসি: গোধরা’, ‘দ্য সবরমতি রিপোর্ট’, ‘দ্য কেরালা স্টোরি’, ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’,  ‘আর্টিকেল ৩৭০’ ছবিগুলো নিয়ে আছে বহুল সমালোচনা।

সীমান্তের গল্প বলতে চেয়েছিল ‘বর্ডার’, যা আগে এদেশে খুব বেশি বলা হয়নি। আটকে থাকা সব সিনেমাগুলোই সমাজের কোনো না কোনো চিত্র তুলে ধরেছে। সেই সাহসে বেড়ি পরাতে চেয়েছে সেন্সর বোর্ড। এখন সময়ই বলে দিবে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ চলচ্চিত্রের জন্য আশীর্বাদ হয় কিনা। 

আরও পড়ুন