ঢাকা, রোববার, ০১ জুন ২০২৫

১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৪ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

আরবের সিনেমা কী থেকে কী বলছে

বিনোদন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০:৩২, ২৯ মে ২০২৫

আরবের সিনেমা কী থেকে কী বলছে

আরব বিশ্বের চলচ্চিত্রজগৎ এক দীর্ঘ, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সংগ্রামমুখর ইতিহাস বহন করে চলেছে। আদি ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা এবং পূর্বপুরুষদের মৌখিক ঐতিহ্য এই শিল্পের বিকাশে নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে। তবুও, বিশ শতকের শুরুতে আরব সিনেমা আত্মপ্রকাশ করে—দুটি ভিন্নধর্মী ধারার মাধ্যমে।

মিশর: আরব সিনেমার প্রাণকেন্দ্র

মিশরে চলচ্চিত্রের সূচনা ঘটে তলা‘আত হারবের হাত ধরে। আমেরিকা থেকে ফিরে এসে তিনি বুঝেছিলেন, সিনেমা শুধু শিল্প নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক ও শিল্প-উদ্যোগ। তিনি একাধারে স্টুডিও গড়েন, আবার একটি ব্যাংকও প্রতিষ্ঠা করেন এই শিল্পকে পুঁজি জোগাতে। সে সময়ের মিশরীয় চলচ্চিত্রে দেখা যায় রোমান্টিক কাহিনি, অ্যাডভেঞ্চার আর গানে ভরপুর কমেডি—যা অনেকটা হলিউডের অনুরূপ। সে যুগের জনপ্রিয় গায়কদের অভিনীত সিনেমা দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।

তিউনিসিয়া: বাস্তবতার দলিল

অন্যদিকে, তিউনিসিয়ার ইহুদি চলচ্চিত্রকার আলবার্ট সামামা চিকলি ছিলেন দ্বিতীয় ধারার পথিকৃৎ। তার কাজ ছিল প্রামাণ্যচিত্রভিত্তিক, যা আরব সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরেছে নিপুণভাবে। তার ছবি ‘জোহরা’ ও ‘দ্য গার্ল অব কার্টেজ’ আজ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত।

এই দুই ধারার—মিশরীয় "থিয়েট্রিক্যাল" ও তিউনিসীয় "ডকুমেন্টারি"—প্রভাব আজও বিদ্যমান, যদিও কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়।

উপনিবেশবাদবিরোধী চলচ্চিত্র: আত্মপরিচয়ের সন্ধানে

সিনেমা আরব বিশ্বে জনপ্রিয় বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে প্রাথমিকভাবে জায়গা করে নেয়, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল সার্কাস বা পথনাটকের ক্ষেত্রে। তবে এক সময়, উপনিবেশবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতে শুরু করে। তারা আরবি অনুবাদে চলচ্চিত্র তৈরি করতে বাধ্য হন—যেমন ‘দ্য থিফ অব বাগদাদ’ ও ‘দ্য ম্যাডম্যান অব কায়রোয়ান’। 

নতুন যুগের আরব চলচ্চিত্র: বাস্তবতার মুখোমুখি

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জন্ম নেন এমন এক প্রজন্ম, যারা প্রেম, সঙ্গীত, বাস্তবতা ও আত্মজিজ্ঞাসার নানা রূপে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে শুরু করেন। উদাহরণস্বরূপ, ইউসেফ শাহিনের ‘দ্য আর্থ’ বা ‘সেন্ট্রাল স্টেশন’ , তৌফিক সালাহর ‘দ্য ভিকটিমস’, আলজেরিয়ার আহমেদ রাশেদির ‘দ্য ওপিয়াম অ্যান্ড দ্য বাটন’। মোহাম্মদ লাখদার হামিনার ‘ক্রোনিকাল অব দ্য ইয়ার্স অব দ্য ব্রাজিয়ার’ এবং ‘ওয়াইন্ড ফ্রম অরিস’ এসব সিনেমা জনগণের অনুভূতি ও সংগ্রামকে তুলে ধরেছে।

তিউনিসিয়ার নূরী বৌজিদের ‘ম্যান অব অ্যাশেজ’ কিংবা নাজিয়া বিন মাবরুকের ‘দ্য ট্রেস’ এর মতো সিনেমাগুলো আরব সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দৈনন্দিন বাস্তবতাকে নতুন ভাষায় প্রকাশ করে।

দোদুল্যমান দ্বন্দ্ব: সমাজ সচেতনতা বনাম বিনোদন

আধুনিক আরব পরিচালকরা এক গভীর সংকটের মুখোমুখি—তারা সমাজের সমস্যাগুলো দেখাতে চান, আবার একই সঙ্গে দর্শকের বিনোদনও নিশ্চিত করতে চান। কেউ কেউ এতটাই বাস্তবতা নির্ভর হয়ে পড়েন যে, তা দর্শকের কাছে দূরবর্তী হয়ে ওঠে। আবার কেউ কেউ পশ্চিমাদের চোখে ‘এক্সোটিক’ ও ওরিয়েন্টাল চিত্র তুলে ধরেন, যা সমালোচকপ্রিয় হলেও আরব দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায়।

নতুন বাস্তবতা ও প্রযুক্তির প্রভাব

স্যাটেলাইট চ্যানেল ও হলিউডি চকচকে সিনেমা একদিকে আরব সমাজে ভোগের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করছে, অন্যদিকে আত্মনিরপেক্ষতায় ঠেলে দিচ্ছে। কেউ কেউ পাশ্চাত্যের দিকে ঝুঁকছেন, কেউ আবার অতীতের গৌরবগাথায় হারিয়ে যাচ্ছেন—এর মাঝেই জন্ম নিচ্ছে উগ্রতা ও সহিংসতা।

এই অস্থির পরিবেশে আরব শিল্পী ও পরিচালকরা অনেকটাই দিশাহারা। তাদের সিনেমা বহু বাধার সম্মুখীন হয়—যেমন, সেন্সরশিপ, প্রযোজনা ব্যয়, স্থানীয় বাজারে অনভ্যস্ততা, পশ্চিমা অর্থায়নে সংশয় ইত্যাদি।

ফরাসি ও ইউরোপীয় সহায়তা: আশীর্বাদ না ষড়যন্ত্র?

অনেক আরব সিনেমা তৈরি হয় ইউরোপের অনুদান দিয়ে। কেউ কেউ এটিকে একটি কৌশলগত “ট্রোজান হর্স” বলেও মনে করেন। তবে একে শুধুমাত্র হস্তক্ষেপ নয়, বরং বিশ্বব্যাপী শিল্পীদের একত্রিত করে সত্যিকারের বৈচিত্র্যপূর্ণ সিনেমা তুলে ধরার প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

ভবিষ্যতের লক্ষ্য: আত্মপরিচয় ও মুক্ত প্রকাশ

আজকের আরব চলচ্চিত্রকারদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজের ক্ষতগুলো স্পষ্ট করে দেখানো, ট্যাবু ভাঙা, বাকস্বাধীনতার চর্চা বাড়ানো, এবং এমন সিনেমা তৈরি করা যা মানুষের কাছে পৌঁছায়। আরব মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী বা মৌলবাদী—এই ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতে পারে কেবল আত্মবিশ্বাসী, বিশ্বাসযোগ্য ও মানবিক চলচ্চিত্র।

শেষ কথা

১৯৯০ সালে যখন তিউনিসীয় সিনেমা ‘হালফাউনি’ ফ্রান্সে মুক্তি পায়, এক সাংবাদিক বলেছিলেন: ‘আমরা ভাবতেই পারিনি, তিউনিস এতটা প্যারিসের কাছাকাছি।’ সিনেমার এই মানবিক সংযোগই পারে বাস্তবতার সেতু তৈরি করতে। আজ প্রয়োজন এমন চলচ্চিত্র, যা উৎসবে নয়, পৌঁছায় মানুষের হৃদয়ে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ

আরও পড়ুন