শিরোনাম
মীর রাকিব হাসান
প্রকাশ: ২০:২৮, ৩০ মে ২০২৫ | আপডেট: ২১:৩৫, ৩০ মে ২০২৫
বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গন রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত—এটি এখন আর নতুন কোনো ব্যাপার নয়। কিছু তারকা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেন, কেউ আবার প্রচারনায় অংশ নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেন। অনেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, কেউ হয়েছেন মন্ত্রী বা উপদেষ্টা। কিন্তু এই বাস্তবতার মধ্যেও আছেন কিছু শিল্পী—যারা রাজনীতির হাতছানি পেলেও সজ্ঞানে তার বাইরে থেকেছেন। তারা বিশ্বাস করেন, শিল্পচর্চা ও রাজনীতির মধ্যে থাকা উচিত একটা পরিস্কার দেয়াল। তাদের কাছে ‘জনপ্রিয়তা’ রাজনীতির সিঁড়ি নয়, বরং দর্শকের আস্থা।
বাংলাদেশ ও ভারতের সিনেমায় সফল অভিনেত্রী জয়া আহসান কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হননি। জয়া বরাবরই রাজনীতির বাইরে থেকে নিজের কাজের মাধ্যমে সমাজে প্রভাব রেখেছেন। নারী অধিকার, সহিংসতা বিরোধী প্রচারণা, পরিবেশবিষয়ক বার্তায় তিনি সক্রিয়—কিন্তু দলীয় রাজনীতিতে নেই কোনো সংশ্লেষ। অনেকেই জানেন জয়া আহসান জন্মসূত্রে গোপালগঞ্জের মেয়ে। ক্ষমতাচ্যূত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এলাকার মেয়ে হয়েও তিনি কখনো রাজনীতিতে জড়াননি। কোনো দলকে অসন্তুষ্টুও করেননি।
শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য ছিলেন অভিনেত্রী ডলি জহুর। শেখ পরিবারের সঙ্গে তার সখ্যতা সেই ছোটবেলা থেকেই। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। মুজিবকন্যা শেখ রেহানা তার খুব কাছের বন্ধু, পুত্র শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়ভাই, আরেককন্যা শেখ হাসিনাকে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করেন তিনি। কিন্তু কখনো হাসিনা সরকারের গা ঘেষেননি। প্রতিটি অনুষ্ঠানে কার্ড পাওয়া সত্বেও তিনি সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে যাননি। বলতেন, আমি আমার ক্ষেত্রে কাজ করে খাই। যাওয়ার লোক আছে। যারা যাওয়ার তারা যাবে। ডলি জহুর বিশ্বাস করতেন, একজন শিল্পীর কাজ তার শিল্প নিয়েই। তিনি নিজেই একাধিকবার বলেছেন—‘আমি আমার কাজের জায়গা থেকে মানুষকে কিছু দিতে চাই। রাজনীতি আমার জায়গা নয়।’ এই বিশ্বাস থেকেই তিনি কখনো রাষ্ট্রীয় সুবিধার আশায় নিজের অবস্থান বদলাননি। শেখ পরিবারের স্নেহধন্য হলেও, কখনো কোনো পদ-পদবি বা অনুগ্রহ চাননি। ডলি জহুর মনে করতেন, শিল্পে রাজনীতির প্রভাব পড়লে তা বিকৃত হয়ে যায়। তিনি নিজেকে শুধু একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন—যার ভূমিকা সমাজের প্রতি, দলের প্রতি নয়। ডলি জহুর কোনো দলীয় পরিচয়ের জন্য কখনো জনপ্রিয়তা পাননি। তাঁর শিল্প, দক্ষতা, এবং সততা তাঁকে বড় করেছে। ডলি জহুর রাজনীতিতে জড়াননি কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন “সম্পর্ক আর রাজনীতি এক নয়’।
ববিতাই প্রথম বাঙালি অভিনেত্রী, যিনি সত্তরের দশকে ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হয়েছিলেন। তারকাজীবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা থাকা সত্ত্বেও রাজনীতির মাঠে কখনো পা রাখেননি ববিতা। কেন তিনি রাজনীতিতে জড়াননি—এই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে বহুবার। বহু সাক্ষাৎকারে বলেছেন—‘আমি মানুষের মন জয়ের রাজনীতি করি। সেই রাজনীতি আমার সিনেমার মাধ্যমে হয়।’ ববিতা, সুচন্দা ও চম্পা—তিন বোনই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আইকনিক তারকা। তাদের পরিবারটি কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ ছিল না।
ছাত্রজীবনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচক্রে যুক্ত ছিলেন হুমায়ূন ফরিদী, এবং স্বভাবতই রাজনৈতিক চেতনা ও সচেতনতা ছিল প্রবল। তবে তিনি মনে করতেন, ‘সংস্কৃতি ও চিন্তার জগত থেকেই পরিবর্তন আনা সম্ভব। সরাসরি দলে না ঢুকেও মানুষকে নাড়া দেওয়া যায়।’ তাঁর কাজ, বক্তব্য এবং উপস্থিতি সবসময় সমাজকে উপলব্ধি করার এবং প্রশ্ন করার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতো। এটা ছিল তাঁর নিজস্ব রাজনীতি—কিন্তু দলীয় নয়। হুমায়ূন ফরিদীর জীবনের প্রতিটি ধাপে লক্ষ্য ছিল শিল্পচর্চা। তিনি বলতেন, ‘একজন ভালো অভিনেতা হয়ে ওঠাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আমি সেই চ্যালেঞ্জেই ডুবে ছিলাম সারাজীবন।’ রাজনীতিতে গেলে তার স্বাধীন অভিনয়জীবন, চরিত্র বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, এমনকি মানুষের সামনে চিন্তা প্রকাশের জায়গাও সংকীর্ণ হয়ে যেত—এই বাস্তবতা তিনি ভালো বুঝতেন। ফরিদী ছিলেন স্পষ্টভাষী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, কিন্তু তিনি কখনো উগ্রবাদী বা দলান্ধ হননি। তাকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে আকর্ষণ ছিল, বিভিন্ন সময় তাকে রাজনীতিতে টানার চেষ্টাও হয়েছিল বলে জানা যায়—কিন্তু তিনি রাজি হননি। ফরিদী বলতেন, ‘আমি মানুষ নিয়ে কাজ করি। দলের হয়ে কাজ করব না, মানুষের হয়ে করব।’ এই বক্তব্যে ফুটে ওঠে তার অবস্থান—রাজনীতির ওপরে ‘মানুষ’। বাংলাদেশে অনেক শিল্পী রাজনীতিতে এসে নিজেকে খণ্ডিত করে ফেলেছেন, দলীয় রংয়ে বিভক্ত হয়েছেন। হুমায়ূন ফরিদী চেয়েছিলেন জনপ্রিয়তার রাজনীতি নয়, বিবেকের রাজনীতি করতে। সে জন্যই দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে সমাজে প্রভাব বিস্তার করে গেছেন। মৃত্যুর আগে রাজনীতি নিয়ে হতাশাও প্রকাশ করেছিলেন। জীবনের শেষ দিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফরিদী বলেছিলেন,‘আমাদের এখানে রাজনীতি মানেই ক্ষমতা, পৃষ্ঠপোষকতা, আর স্তুতির খেলা। সেখানে শিল্পী বা চিন্তক যদি যায়, সে হয়তো স্বাধীনতা হারায়।’ এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, তিনি রাজনীতিকে দূর থেকে দেখেছেন, ভালো-মন্দ বুঝেছেন, কিন্তু নিজেকে রক্ষা করেছেন।
নব্বইয়ের দশক থেকে ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত শাবনূর ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের একজন। কিন্তু তিনি কখনো রাজনীতিতে জড়াননি। শাবনূর সবসময়ই ছিলেন একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের। চলচ্চিত্রের বাইরে খুব একটা সোশ্যাল বা রাজনৈতিকভাবে দৃশ্যমান ছিলেন না তিনি। রাজনীতি যেহেতু বিতর্ক, দলীয় দৃষ্টি, ও পাবলিক অবস্থান গ্রহণের জায়গা—তাই তার মতো শিল্পীদের জন্য তা স্বস্তিকর নয়। রাজনীতি অনেক তারকার জন্য ‘দ্বিতীয় ক্যারিয়ার’ হলেও, শাবনূর তার প্রথম ক্যারিয়ারেই সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছান।
জনপ্রিয় গায়ক ও সুরকার হাবিব ওয়াহিদ সব সময়েই রাজনীতির বাইরে থেকেছেন। কোনো সরকারের আমলেই তাকে কখনো রাষ্ট্রীয় মঞ্চে দেখা যায়নি। তবে সমাজ সচেতনতামূলক বার্তায় তিনি যুক্ত থেকেছেন। তাঁর মতে-‘রাজনীতি নয়, ভালো গানই মানুষের চিন্তা বদলায়।”
অনেক তারকা বিশ্বাস করেন, রাজনীতিতে যুক্ত হলে তাদের দর্শক বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো রাজনীতি-সংবেদনশীল দেশে এক পক্ষ নিলে বিপক্ষ প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে—এটি অনেক শিল্পীর বাস্তব উপলব্ধি। রাজনৈতিক ছাতার নিচে গেলে অনেক সময় শিল্পীকে নির্দিষ্ট বয়ান অনুসরণ করতে হয়। সেটা এড়িয়ে চলতেই কেউ কেউ রাজনীতি এড়িয়ে চলেন। কিছু শিল্পী ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতিকে মূল্যহীন বা দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করেন। তাই তারা নিজেই যুক্ত হতে চান না।
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ