ঢাকা, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

৭ আষাঢ় ১৪৩২, ২৪ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

ইরানে হামলার দুই প্রধান মাস্টারমাইন্ড

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ২২:১০, ২০ জুন ২০২৫

ইরানে হামলার দুই প্রধান মাস্টারমাইন্ড

গত সপ্তাহে ইরানের ভেতরে ইসরায়েলের সরাসরি সামরিক অভিযানে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। এই নজিরবিহীন হামলায় ইরানের পরমাণু স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অবকাঠামো, শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং পরমাণুবিজ্ঞানীরা লক্ষ্যবস্তু হন। এই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তের পেছনে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু—তবে তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুই নির্ধারক ব্যক্তি: মোসাদপ্রধান ডেভিড বার্নিয়া এবং বিমানবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল তোমার বার।

‘এক মিলিমিটারও এদিক–সেদিক হয়নি’

ইসরায়েলের এক সিনিয়র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা এই অভিযানকে ‘অবিশ্বাস্যভাবে নিখুঁত’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ভাষায়, “মোসাদের স্থল অভিযানের সঙ্গে বিমানবাহিনীর আকাশ হামলার এমন নিখুঁত সমন্বয় ছিল যে, এক মিলিমিটারও এদিক-সেদিক হয়নি। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে বিখ্যাত ‘বিপার অপারেশন’–কেও ছাপিয়ে যাবে।”

ইরানে হামলার নেপথ্যে বার্নিয়া

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বর্তমান প্রধান ডেভিড বার্নিয়া অনেক দিন ধরেই ইরানে হামলার পক্ষে ছিলেন। ২০২১ সালে মোসাদের প্রধান হওয়ার পর তিনি সংস্থাটিতে ‘বায়োমেট্রিক বিপ্লব’ ঘটান এবং আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফল প্রয়োগ ঘটান। স্মার্ট ক্যামেরা, ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তি এবং নিজস্ব ড্রোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ইরানে গুপ্তচরবৃত্তি ও তথ্য সংগ্রহের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন তিনি।

২০২৪ সালে পরিচালিত ‘বিপার অপারেশন’-এ হিজবুল্লাহর হাজার হাজার পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সফল অভিযান হিসেবে বিবেচিত।

অভিযানের সময় বেছে নেওয়া হয়েছিল কৌশলে

গত বছর গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ এবং ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে বড় ধরনের প্রাণহানির পর বার্নিয়া আরও দৃঢ় হন ইরানে জবাব দেওয়ার প্রশ্নে। মোসাদ ও সামরিক গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, ইরানের ভেতরে স্যুটকেস, ট্রাক, এমনকি কনটেইনারের ভেতরে ড্রোন ও অস্ত্রের অংশ পাচার করে মোসাদ। এগুলো পরে ইরানেই জোড়া লাগানো হয়। হামলার সময় এগুলোকে সক্রিয় করে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীকে নিরাপদে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে সহায়তা করা হয়।

জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ছাড়পত্রে গোপন পরিকল্পনা

ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবিও ছিলেন এই সিদ্ধান্তের পেছনে। তিনিই নেতানিয়াহু ও আইডিএফের (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) সমর্থন নিশ্চিত করেন। নিরাপত্তা পরিষদে এই পরিকল্পনা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।

উল্লেখ্য, অতীতে আইডিএফের যাঁরা প্রধান ছিলেন—যেমন গাবি আশকেনাজি, বেনি গানৎজ ও গাদি আইজেনকোট—তাঁরা সবাই ইরান আক্রমণের বিরোধী ছিলেন। এমনকি, ২০১৫ সালের ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তির পর ইরান হামলার ভাবনাও বাতিল হয়ে গিয়েছিল।

বার্নিয়ার প্রভাব ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ

৬০ বছর বয়সী বার্নিয়া মিডিয়ার আলো থেকে দূরে থাকেন। তাঁর কোনো রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই বলে জানা গেছে।  অবসরের পর যদি তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হতে চান, তবে অনেক রাজনৈতিক দলই তাঁকে শীর্ষ নেতৃত্বে চাইবে—এমন ধারণা ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

তাঁর ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, “তিনি কখনোই রাজনৈতিক লড়াইয়ে যেতে চান না। মোসাদের প্রধান হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব ক্ষমতা অসাধারণ, কিন্তু জাতীয় রাজনীতির চূড়ায় পৌঁছানোর ইচ্ছা তাঁর নেই।”

‘ইরান ভুল করেছে, এবার সে ফল ভোগ করছে’

একজন শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘ইরান বারবার ধরে নিয়েছে, আমরা কিছুই করব না। তারা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বিধা দেখেছে। তারা জানে, বাইডেন বা ট্রাম্প কেউই ইরান আক্রমণে উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু এবার তারা ভুলের ফল ভোগ করছে। ইসরায়েল তাদের বিস্মিত করতে পেরেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র এখন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে ইরান পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে যাবে। তখন পারমাণবিক হুমকি নির্মূল করার বিষয়েও আমরা সফল হব।’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব এক নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এবার যে মাত্রায় হামলা হয়েছে, তা শুধু একটি কৌশলগত আঘাত নয়, বরং গোয়েন্দা ও সামরিক সমন্বয়ের এক যুগান্তকারী উদাহরণ হিসেবেই ইতিহাসে লেখা থাকবে। এই হামলা শুধু নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক চাল নয়, বরং মোসাদের সুনির্দিষ্ট তথ্য, অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি ও প্রযুক্তির নিখুঁত ব্যবহারের ফল।

রিপোর্ট: শালোম ইয়েরুসালমি, টাইমস অব ইসরায়েল। 

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন