ঢাকা, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

১১ আষাঢ় ১৪৩২, ২৮ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

শিরোনাম

Scroll
পৃথিবীর সর্বনাশের জন্য আমরা দায়ী; আমরা সবাই আসামি: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
Scroll
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন
Scroll
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ
Scroll
এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে বৃহস্পতিবার, অংশ নিবে সাড়ে ১২ লাখ শিক্ষার্থী
Scroll
ইসরায়েলের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে তিন ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর করেছে ইরান
Scroll
যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়নি: পেন্টাগনের গোয়েন্দা বিভাগ ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (ডিআইএ) প্রতিবেদন
Scroll
ইসরায়েল অন্তত ১৪ ইরানি বিজ্ঞানীকে হত্যা করার দাবি করেছে
Scroll
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় আরো ৮৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন

অর্থনীতির জন্য আগামী বছর শঙ্কার, পূর্বাভাস আন্তর্জাতিক সংস্থার

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১১:৩৯, ২৫ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১১:৫৬, ২৫ জুন ২০২৫

অর্থনীতির জন্য আগামী বছর শঙ্কার, পূর্বাভাস আন্তর্জাতিক সংস্থার

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকটময় সময় পার করছে। প্রবৃদ্ধির ধীরগতি, রাজস্ব ঘাটতি, ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা মিলিয়ে সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো অবস্থায় নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাস বাংলাদেশ অর্থনীতির সামনে এক অনিশ্চিত ও কঠিন সময়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ দিকে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি চার শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পরিস্থিতি আরো জটিল ও গভীর হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দুই আন্তর্জাতিক সংস্থা।

বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা বিগত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সঙ্গে আইএমএফও তাদের পূর্বাভাস কমিয়ে তিন দশমিক আট শতাংশে নামিয়েছে, যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক তিন দশমিক ৯৭ শতাংশ হিসাব থেকেও কম। এই দুটি পূর্বাভাসই এক গভীর বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত দেয়, যেখানে কেবল স্বাভাবিক নীতি প্রয়োগ বা সাময়িক উদ্যোগ যথেষ্ট হবে না— দরকার গভীর কাঠামোগত সংস্কার।

ওয়াশিংটনে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড সভায় ২৩ জুন বাংলাদেশকে এক দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সংস্থাটি আরো ৮০০ মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এই অর্থায়নের সঙ্গে সংযুক্ত শর্ত ও পূর্বাভাসে আইএমএফ কঠোর বার্তা দিয়েছে— যেখানে বলা হয়েছে, কাঠামোগত দুর্বলতা দূর না করা গেলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। সংস্থাটি মনে করে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার এবং দুর্বল ব্যাংক খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নাইজেল ক্লার্ক এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমাত্রিক চাপের মুখে রয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, ব্যাংক খাত সংস্কার এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গভীর ও সময়োপযোগী নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি মনে করেন, কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পুনর্গঠনই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার দুর্বলতাও এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৬ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। মে মাস পর্যন্ত মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে তিন লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা; যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮৩ দশমিক ১০ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণে জুন মাসেই এক লাখ ৩৫ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা আদায় করতে হবে; যা বিশ্লেষকদের মতে কার্যত অসম্ভব।

অন্যদিকে, ব্যাংক খাতের সংকটও চরম আকার ধারণ করেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা; যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বছরের শেষে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ আট লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। তারল্য সংকটে ভোগা ব্যাংকগুলো এখন নতুন বিনিয়োগে ঋণ দিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে, ফলে অর্থনীতির উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপি ঋণের এই লাগামহীন বৃদ্ধি শুধু ব্যাংক খাতকেই নয়, বরং পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা, যাদের জন্য ব্যাংকিং সেবা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।

সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নির্ভরতার বিষয়টিও পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে এক দশমিক ০৪ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিতে চায়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ঋণ তারল্য সংকট আরো বাড়াবে এবং বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ গ্রহণের সুযোগ সংকুচিত করবে। এতে সুদের হার বৃদ্ধি পাবে; যা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

মূল্যস্ফীতির চাপও অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলছে। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি নয় দশমিক নয় শতাংশে অবস্থান করছে; যা ভোক্তা পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করছে। যদিও আগামী অর্থবছরে তা কমে ছয় দশমিক দুই শতাংশে নামার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কিছু। বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, হরমুজ প্রণালির অস্থিরতা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।

বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি আবারো বেঁধে যায় এবং হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে জ্বালানি পরিবহন ব্যাহত হয়, তবে জ্বালানি আমদানির খরচ বেড়ে যাবে এবং দেশের উৎপাদন খরচ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতা অব্যাহত থাকতে পারে এবং বাংলাদেশেও ভোক্তা পর্যায়ের খরচ আরো বেড়ে যাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়, আমদানি-রপ্তানি এবং শ্রমবাজারে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী চাকরি হারাতে পারেন। তেল ও গ্যাসের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে দেশের শিল্প খাতেও উৎপাদন ব্যাহত হবে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতি নষ্ট করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর অবশ্য জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। মঙ্গলবার (২৪ জুন) ঢাকায় ‘গুগল পে’ সেবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সরকার মূল্যস্ফীতি ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশে নামাতে চায়। তবে আমরা আরও আগ্রাসী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি— পাঁচ শতাংশে নামাতে পারলে সেটিই হবে আমাদের সফলতা।

অন্যদিকে, বিনিয়োগ এবং রপ্তানি খাতে দেখা যাচ্ছে এক গভীর স্থবিরতা। দেশের ভেতরে ও বাইরে উভয় জায়গায় বিনিয়োগ প্রবাহ কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা স্থিতিশীল রাখতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি সীমিত করা হচ্ছে, কিন্তু এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কর্মসংস্থানে এর নেতিবাচক প্রভাবও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ডলার সংকট শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত করছে। এতে ঋণখেলাপির আশঙ্কা বাড়ছে।

একইসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানিয়েছেন, পোশাক খাতে ঋণপ্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়েছে। তিন মাসের খেলাপি সীমা নিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে আমরা আলোচনা শুরু করছি।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন