শিরোনাম
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩:৩৪, ১৪ জুন ২০২৫ | আপডেট: ০১:৫৪, ১৫ জুন ২০২৫
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। পরবর্তী ২৬ বছর ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ছিল ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরই সেই সম্পর্ক রূপ নেয় চরম বৈরিতায়। ১৯৮০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরকে সন্ত্রাসে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
রেজা শাহের আমলে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশ ছিল ইরান। কিন্তু ইসলামিক বিপ্লবের পর খোমেনি একে "শত্রু রাষ্ট্র" হিসেবে ঘোষণা করেন। ইসরায়েল বারবার অভিযোগ করে আসছে, তেহরান পরমাণু অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ইরান হামাস ও হিজবুল্লাহকে সমর্থন দিয়ে থাকে—যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালায়।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে সৌদি আরব ও ইরান একে অপরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। দুই দেশের ছায়াযুদ্ধ চলছে ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকে। ২০১৯ সালে সৌদির তেলক্ষেত্রে হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করেছিল রিয়াদ। যদিও সম্প্রতি চীন-নেতৃত্বাধীন এক উদ্যোগে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকের চেষ্টাও চলছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরানে প্রবেশ করে, যুদ্ধ শেষে দীর্ঘ সময় দখলদারি বজায় রাখে।
তবে বর্তমানে রাশিয়া ও ইরান কৌশলগতভাবে ঘনিষ্ঠ। সিরিয়া সংকটে একসঙ্গে জড়িত দুই দেশ। রাশিয়া ইরানকে ড্রোন ও অস্ত্র চুক্তিতে পাশে পাচ্ছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে মস্কো-তেহরান জোট এখন অনেক শক্তিশালী।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় চীন ইরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। বর্তমানে চীন হলো ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চীন অনেক সময়েই ইরান থেকে তেল আমদানি করে। চীনের কূটনৈতিক ভাষ্য, তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক ‘অটুট’ থাকবে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক সবসময়ই ছিল আলোচনা-কেন্দ্রিক। ২০১৫ সালের চুক্তি (JCPOA) থেকে ট্রাম্প প্রশাসন বের হয়ে গেলেও, ইইউ দেশগুলো এখনও চুক্তিকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে। ইরানের ওপর ইউরোপ কোনো বড় ধরনের সামরিক চাপ না দিলেও, মানবাধিকার ইস্যুতে তারা মাঝে মাঝে সমালোচনামুখর।
ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-৮৮) ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ভয়াবহতম। তবে বর্তমানে ইরাকের শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকার ও ইরান ঘনিষ্ঠ মিত্র। তেহরান বেশ কয়েকটি ইরাকি মিলিশিয়া গোষ্ঠীকেও সমর্থন দেয়, যারা মাঝে মাঝে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায়।
হিজবুল্লাহ (লেবানন): ১৯৮০-এর দশকে ইরানের সহায়তায় গঠিত। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সক্রিয়।
হামাস (ফিলিস্তিন): গাজাভিত্তিক ইসলামপন্থী গোষ্ঠী, ইরানের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পায়।
হুতি (ইয়েমেন): সৌদি-সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে, ইরানের কাছ থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পায়।
অবরোধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট আর দুই দেশের একই শত্রু, ইরান-ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে এসেছে কাছাকাছি। ২০০১ সালে ইরানের মোহাম্মদ খাতামি আর ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের মাধ্যমে সহযোগিতামূলক এই সম্পর্কের গোড়াপত্তন। আহমদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর তা আরো নিবিড় হয়। একক শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে দুইদেশ বেশি কিছু চুক্তিও করেছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৯৯৫ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ঢাকায় আসেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও দ্বিপক্ষীয় সফর বেড়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানির মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ এখনো ইরানে টেক্সটাইল ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে যাচ্ছে।
ইরান তার বিপ্লব-পরবর্তী চার দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘মিত্র’ ও ‘শত্রু’ বেছে নিয়েছে কৌশলগতভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে থেকে চীন, রাশিয়া ও কিছু আঞ্চলিক গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে তেহরান তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রতিটি সম্পর্কই সময় ও প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনশীল—যার ভেতর দিয়ে ইরান বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের জন্য জায়গা তৈরি করে নিচ্ছে।
এমআরএইচ