ঢাকা, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

১ আষাঢ় ১৪৩২, ১৮ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: যুদ্ধে জড়াতে পারে যে দেশগুলো

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫:৫৬, ১৫ জুন ২০২৫

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: যুদ্ধে জড়াতে পারে যে দেশগুলো

গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ইরানে ইসরায়েলের চালানো নজিরবিহীন হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৭৮ জন, যাঁদের মধ্যে আছেন ইরানের সামরিকপ্রধান, শীর্ষ কয়েকজন জেনারেল ও পরমাণু বিজ্ঞানী। পাল্টা জবাবে ইরানও একাধিক দফায় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে। দুই পক্ষের এই পাল্টাপাল্টি হামলা গতকাল শনিবারও অব্যাহত ছিল।

সংঘাত ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে—এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি কেবল ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি ছড়িয়ে পড়বে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও তার বাইরেও?

যুক্তরাষ্ট্র কি সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে?

ইরানে হামলার পর মার্কিন প্রশাসন দ্রুত জানিয়ে দেয়, এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, ওয়াশিংটন আগেই এই হামলার বিষয়ে অবগত ছিল। মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও কূটনৈতিক মিশনগুলো—বিশেষ করে ইরাক ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ঘাঁটিগুলো এখন ইরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধের ঝুঁকিতে।

ইরানের ঘনিষ্ঠ মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো যেমন ইরাকের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় রয়েছে এবং তারা মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে। পরিস্থিতি যদি এমন জায়গায় গড়ায় যেখানে কোনো মার্কিন নাগরিক হতাহত হন, তাহলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে আর নিরপেক্ষ থাকা কঠিন হবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানের গোপন ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংসে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্রের বাঙ্কারবিধ্বংসী বোমা ও বিশেষ বোমারু বিমান রয়েছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হামলায় যুক্ত হলে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী এক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

উপসাগরীয় দেশগুলো কি সংঘাতে জড়াবে?

ইরান যদি ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংসে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের লক্ষ্য হতে পারে উপসাগরীয় দেশগুলোর অবকাঠামো। অতীতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর ইরানপন্থী হুতি গোষ্ঠীর হামলার নজির রয়েছে।

আরব উপসাগরের অনেক দেশই ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতায় যুক্ত। এমন দেশগুলোর তেলক্ষেত্র, বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা মার্কিন ঘাঁটিগুলো ইরানের রোষানলে পড়তে পারে। ফলে সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের আরও বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আরও এগোতে পারে

ইসরায়েল তার হামলাকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু এর জবাবে ইরান বরং পারমাণবিক কর্মসূচিকে আরও গতি দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।

বর্তমানে ইরানের হাতে থাকা ৪০০ কেজির বেশি ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ, যা পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রায় পর্যাপ্ত। ইসরায়েলের হামলা যদি তাদের নিরাপত্তা অনুভূতিকে আরও দুর্বল করে তোলে, তাহলে তেহরান এ থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে হাঁটতে পারে। এই প্রক্রিয়া শুরু হলে সংঘাত আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

বৈশ্বিক অর্থনীতি পড়তে পারে চাপে

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর আগেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালি—যা দিয়ে বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ তেল পরিবাহিত হয়—ইরান যদি সেটি বন্ধের হুমকি দেয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতি গভীর সঙ্কটে পড়বে।

ইয়েমেনের হুতিরা এরই মধ্যে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে বাধা দিয়ে রেখেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথগুলো আরও ঝুঁকিতে পড়েছে। কোভিড, ইউক্রেন যুদ্ধ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই এমন সংঘাত আবার বিশ্ব অর্থনীতিকে টেনে নিতে পারে মন্দার দিকে।

তবে এই পরিস্থিতিতে লাভবান হতে পারে রাশিয়া। কারণ, তেলের দামের বৃদ্ধিতে তাদের রাজস্ব বাড়বে, যা ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

ইরানে সরকার পতনের ঝুঁকি?

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য শুধু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামানো নয়—বরং দেশটির সরকারকেও পতনের দিকে ঠেলে দেওয়া। যদিও এটি বাস্তবায়ন হলে তা শুধু ইরানের জন্য নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে।

ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় সরকার পতনের পর কী ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। ইরানে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ধসে পড়লে সেখানে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হবে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী তা পূরণের চেষ্টা করবে। তার ফলে দেশটি গৃহযুদ্ধ বা দীর্ঘমেয়াদি বিশৃঙ্খলার মুখে পড়তে পারে।

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ক্রমেই মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব রাজনীতিকে বিপজ্জনক এক মোড়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুই পক্ষের প্রতিহিংসার বলয়ে যদি বড় শক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা শুধু একটি অঞ্চলের সমস্যা থাকবে না—এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী। এখন সময় সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার, নয়তো অনিবার্য এক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব।

এমআরএইচ

আরও পড়ুন