শিরোনাম
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০০:৪৩, ১৫ জুন ২০২৫
ইরানে সামরিক কমান্ডার, পরমাণুবিজ্ঞানী এবং অভিজাত বাহিনী ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) নেতারা ছিলেন হামলার লক্ষ্যবস্তু। তাঁদের অনেকেই তখনো ‘নিজের বিছানায়, নিজের বাড়িতে’ ছিলেন। কে কোথায় আছে সবটাই জানত মোসাদ।
ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ—যার নাম শুনলেই ভেসে ওঠে রহস্য, চৌকস অপারেশন আর নজিরবিহীন গোপন অভিযান। একদিকে বিস্ময়কর সাফল্য, অন্যদিকে বিতর্কিত ব্যর্থতা। কখনও প্রশংসিত, কখনও নিন্দিত—মোসাদ যেন ইসরায়েলের এক ছায়াযোদ্ধার নাম।
চলুন দেখে নিই এই সংস্থার উল্লেখযোগ্য কিছু সাফল্য ও ব্যর্থতা।
অ্যাডলফ আইকম্যান অপহরণ (১৯৬০)
‘হলোকাস্টের’ মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন নাৎসি নেতা অ্যাডলফ আইকম্যান লুকিয়ে ছিলেন আর্জেন্টিনায়। মোসাদের ১৪ সদস্যের একটি গোপন দল তাকে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে আসে। সেখানে তার বিচার ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় গুপ্ত অভিযান।
উগান্ডায় হাইজ্যাক হওয়া একটি বিমানের ১০০ জনের বেশি জিম্মিকে মুক্ত করে ইসরায়েলি কমান্ডো বাহিনী, যাদের তথ্য সহায়তা দিয়েছিল মোসাদ। অভিযানে একমাত্র ইসরায়েলি কমান্ডো যিনি নিহত হন, তিনি ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভাই ইয়োনাতান নেতানিয়াহু।
সুদানে একটি নকল ডাইভিং রিসোর্ট খুলে গোপনে ৭,০০০ ইথিওপিয়ান ইহুদিকে ইসরায়েলে পাচার করে মোসাদ। দিনের বেলায় এজেন্টরা রিসোর্টের কর্মী, রাতের বেলায় মানবপাচারকারী! পাঁচ বছর ধরে চলা এই অভিনব অপারেশন বিশ্বজুড়ে চমক সৃষ্টি করেছিল।
মিউনিখ অলিম্পিকে ১১ জন ইসরায়েলি খেলোয়াড়কে হত্যার জবাবে, মোসাদ ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ও পিএলও-এর একাধিক নেতাকে টার্গেট করে হত্যা করে। এর মধ্যে মাহমুদ হামশারি-র হত্যাকাণ্ড ছিল সবচেয়ে আলোচিত, যার ফোনে বিস্ফোরক বসিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
হামাসের বোমা বিশেষজ্ঞ ইয়াহিয়া আয়াশ–কে মোসাদ হত্যা করে একটি মোবাইল ফোনে বিস্ফোরক বসিয়ে। তার মৃত্যু ছিল ইসরায়েলের কাছে বড় এক প্রতিশোধ, কারণ আয়াশ ছিলেন দেশটির মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টের শীর্ষে।
হামাস নেতা মাহমুদ আল-মাভুহ-কে দুবাইয়ের একটি হোটেলে হত্যা করা হয়। প্রথমে মনে হয়েছিল প্রাকৃতিক মৃত্যু, পরে ভিডিও ফুটেজে হত্যার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মোসাদের জড়িত থাকার সন্দেহ উড়িয়ে দেয়নি কেউই, যদিও ইসরায়েল কখনো দায় স্বীকার করেনি।
জর্ডানে হামাস নেতা খালেদ মেশাল-কে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার চেষ্টা করে মোসাদ। এজেন্টরা ধরা পড়ে গেলে কূটনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয় এবং ইসরায়েলকে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ দিতে বাধ্য করা হয়। এই ব্যর্থতা ইসরায়েল-জর্ডান সম্পর্কে বড় ধাক্কা দেয়।
গাজায় হামাস নেতা আল-জাহার-এর বাসভবনে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। আল-জাহার বেঁচে গেলেও তার স্ত্রী, ছেলে ও অন্যান্যরা নিহত হন। এটি ছিল নাগরিকদের প্রাণহানির দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা এক ব্যর্থ সামরিক পদক্ষেপ।
মিশরে মার্কিন ও ব্রিটিশ স্থাপনায় বোমা হামলার পরিকল্পনা করেছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। অভিযানের লক্ষ্য ছিল ব্রিটেনকে মিশরে থেকে যাওয়ার যুক্তি দেওয়া। কিন্তু পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে ইসরায়েল কূটনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিনহাস লাভন-কে পদত্যাগ করতে হয়।
মোসাদ ব্যর্থ হয় মিশর-সিরিয়ার আগাম হামলার তথ্য দিতে। ইয়োম কিপ্পুর, ইহুদি ধর্মীয় দিনটিকে সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়ে দু’দিক থেকে ইসরায়েলের উপর হামলা চালায় মিশর ও সিরিয়া। যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে ইসরায়েল দিশেহারা হয়ে পড়ে।
প্রায় ৫০ বছর পর, গাজা সীমান্ত দিয়ে হামাস আকস্মিকভাবে ইসরায়েলে হামলা চালায়। ১,২০০ বেসামরিক ইসরায়েলি নিহত এবং ২৫১ জন জিম্মি হয়। গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে এটি মোসাদের একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ধাক্কা বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
মোসাদের অপারেশনগুলো শুধু সেনা অভিযান নয়, এগুলো একেকটি রাষ্ট্রীয় কৌশল, কূটনীতি এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের উপাখ্যান। কখনও জঙ্গিদের শায়েস্তা করে নায়কের মর্যাদা পেয়েছে, আবার কখনও ব্যর্থতায় পড়ে প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে।
তবে একটি বিষয়ে সন্দেহ নেই—মোসাদ শুধু এক গুপ্তচর সংস্থার নাম নয়, বরং ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষার ছায়াযুদ্ধের প্রতীক।
এমআরএইচ