ঢাকা, সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫

২০ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৯ সফর ১৪৪৭

পাঁচ দাবিতে আন্দোলন

জনকণ্ঠের সম্পাদকসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০:২৮, ৪ আগস্ট ২০২৫

জনকণ্ঠের সম্পাদকসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

ছবি: সংগৃহীত

জনকণ্ঠ পত্রিকার ‘নিউজ কার্ডের’ ‘লাল-কালো’ রং নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ শেষ পর্যন্ত মামলায় গিয়ে ঠেকেছে। সম্পাদক শামীমা এ খানসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পত্রিকাটির উপপ্রধান প্রতিবেদক ইস্রাফিল ফরাজি।

এর আগে জনকণ্ঠের সম্পাদককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে একটি ’সম্পাদকীয় বোর্ড’ গঠন করে পত্রিকাটির একদল কর্মী। তারা পাঁচ দাবি নিয়ে আন্দোলনেও নেমেছেন।

এ অংশটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সময়ে পত্রিকাটিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাজু বলেন, শনিবার রাত ১২টার পরে এ মামলা হয়, যেখানে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের ভাইস চেয়ারম্যানকেও আসামি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০২৫ সালের সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে এ মামলা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১৫ জনের নাম রয়েছে। বাকিরা ‘অজ্ঞাত’। মামলার তদন্ত চলছে, কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

আসামির তালিকায় আছেন– জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত অতিকুল্লাহ খান মাসুদের স্ত্রী সম্পাদক শামীমা এ খান, তার ছেলে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের ভাইস চেয়ারম্যান জিসাল এ খান, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, সরকারি হিসাবরক্ষক মোস্তাক আহমেদ, সহকারি হিসাবরক্ষক মোশাররফ হোসেন, মানবসম্পদ বিভাগের ফারহানা খান, পত্রিকাটির জেনারেল ম্যানেজার মফিজুর রহমান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আজাদ সোলায়মান, আওয়ামী লীগের ‘অনলাইন একটিভিস্ট’ মারুফ হোসাইন, ছাত্রলীগ কর্মী ইয়াছার আরাফাত, মো. আশিক, মো. ওয়াসিম আকরাম, অমিত দে, যুবলীগের মো. বিশাল খান ও সরদার সানিয়াত হোসেন।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, ১ আগস্ট সকাল ৬টায় জনকণ্ঠ পত্রিকার ফেইসবুক পেজে আওয়ামী লীগের শোক দিবসের কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে ‘নিউজ কার্ডে’ লাল রং থেকে কালো রং করা হয়। এ নিয়ে সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা তৈরি হয় বলে তুলে ধরা হয়।

বাদীর ভাষ্য, বিষয়টি শামীমা খান, তার ছেলে জিসাল এ খান এবং জাকির হোসেনকে জানালে তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়ে লাল থেকে কালো রং ধারণ করার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন।

মামলায় বলা হয়, ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে সাংবাদিক আজাদ সোলায়মান অফিসে এলে তাকে সমাধানের জন্য বলা হলে তার সঙ্গে থাকা অন্যরা পত্রিকার প্ল্যনিং এডিটর জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির, সাংবাদিক মীর জসীম, অনলাইন উপদেষ্টা সাবরিনা বিনতে আহমেদসহ অন্যদের ওপর চড়াও হয় এবং হুমকি দেয়।

সাবরিনাকে যৌন নির্যাতন করা হয় বলেও অভিযোগ করা হয় মামলায়।

এ ব্যাপারে জনকণ্ঠের সম্পাদক শামীমা এ খান বলেন, লালকে কালো করার কোনো সিদ্ধান্তই ছিল না। এই লাল-কালো নিয়ে যে কথা উঠেছে, সেটা তাদেরই (আন্দোলনকারী অংশ) পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে। এটা পুরো স্যাবোটাজ, এটা না করতে পারলে তারা এ অবস্থা সৃষ্টি করতে পারত না।

অফিসের বাইরে অবস্থান করার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, তারা এখন বাসে করে লোক নিয়ে আসছে। পুলিশ প্রশাসন কোনো সহযোগিতা করছে না।

শামীমা এ খান বলেন, মামলা হওয়ার বিষয়টি এখনো তিনি জানেন না।

আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা জনকণ্ঠ পত্রিকার বিভিন্ন হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত ছিল বলে মামলায় বলা রয়েছে।

এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মালিক পক্ষ সবার সহায়তায় সাইবার স্পেস ব্যবহার করে ছবি ও সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করে জাতিগত বিদ্বেষ ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

এদিকে ‘সম্পাদকীয় বোর্ড সদস্য’ ইস্রাফিল ফরাজির পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, মালিকপক্ষের ‘ফ্যাসিবাদী’ বেশ ধারণের প্রতিবাদে আগামী দুই দিন (সোমবার ও মঙ্গলবার) মুদ্রণ সংস্করণে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতিতে ছাপাখানা বন্ধ থাকবে।

পরে ইস্রাফিল ফরাজি বলেন, রবিবার কাজ হয়, সোমবার পত্রিকা বাজারে আছে। তবে মঙ্গল ও বুধবার বাজারে পাওয়া যাবে না।

তিনি বলেন, অনলাইন ও ই- পেপার চালু থাকবে।

এদিকে রাত ১টার দিকে পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণের প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে কারো নাম দেখা যায়নি।

সেখানে লেখা রয়েছে, সম্পাদকমণ্ডলী কর্তৃক গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার-এর সদস্য প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে গ্লোব প্রিন্টার্স লি. ও জনকণ্ঠ লি. থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

পত্রিকাটির রবিবারের মুদ্রণ সংস্করণের ই-পেপারেও সম্পাদক কিংবা প্রকাশকের নাম নেই। সেখানেও প্রিন্টার্স লাইনে একই কথা লেখা রয়েছে।

এ বিষয়ে পত্রিকাটির মালিক পক্ষ, মালিকবিরোধী পক্ষ ও কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে আলাপের বরাতে বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, আওয়ামী লীগের পতনের কিছুদিন আগে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা আফিজুর রহমান।

মালিকপক্ষ অভিযোগ করেছে, আওয়ামী লীগের পতনের পর আফিজুর রহমান বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে পত্রিকাটিতে সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দেন। একজন বিএনপি নেতার স্ত্রীকেও তিনি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেন।

পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক শামীমা এ খান বিবিসি বাংলাকে অভিযোগ করেন, আফিজুর রহমানই পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুন লোকজন এনেছে এবং তারা ষড়যন্ত্র করে পত্রিকা দখল করেছে।

‘তারাই আগস্টে পত্রিকার ব্যানারে লাল-কালো ইস্যু তুলে সাবোটাজ করেছে। নিজেরাই পত্রিকার টেম্পলেট কালো করে আমাদের নামে প্রচার করে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

বিবিসি বাংলা বলছে, শামীমা এ খান শনিবার রাতে ষড়যন্ত্র করে জনকণ্ঠ ভবনে 'মব সৃষ্টি করে অবৈধভাবে দখলের' অভিযোগ তোলেন।

তার এই অভিযোগ আফিজুর রহমান, এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও পত্রিকাটির প্লানিং এডভাইজর জয়নাল আবেদীন শিশিরসহ বিএনপি ও জামায়াতপন্থি কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে।

আফিজুর রহমান ও জয়নাল আবেদীন শিশির উভয়েই বিবিসি বাংলার কাছে জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

আফিজুর রহমান বলেন, প্রতিষ্ঠানকে ‘সেইফ ও সাসটেইন’ রাখতে যা করার, নিয়োগের ক্ষেত্রে সেটিই করেছি। হাউজ দখলের প্রশ্নই আসে না। এ ধরনের অভিযোগ আমি ডিজার্ভ করি না। ম্যাডাম (সম্পাদক) অনেকগুলো অসত্য বলেছেন।

বিবিসি বলছে, আফিজুর রহমান আওয়ামী লীগ আমলে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইতে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

এর আগে মে মাসেও জনকণ্ঠ ভবনে মব তৈরি করে হামলার অভিযোগ উঠেছিল। তখনো এনসিপি নেতা জয়নাল আবেদীন শিশিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে এবং দল থেকে তার কাছে ব্যাখ্যাও দাবি করা হয়।

এবারের ঘটনা প্রসঙ্গে শিশির বলেন, দখলের অভিযোগ আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ভাষ্য। আমরা এখনো মালিকানা ও প্রকাশনায় নেই। পরিচালনার জন্য শুধু একটা বোর্ড করেছি। কর্মরত সব সাংবাদিকদের সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিবিসি বাংলা বলছে, সবশেষ বিরোধ সামনে আসে আগস্ট থেকে পত্রিকার ব্যানার লাল ও কালো করা নিয়ে। এ ঘটনার জের ধরে মালিকপক্ষ বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি সমর্থক হিসেবে আসা নয় জনকে চাকরিচ্যুত করলে তারাও পাল্টা অবস্থান নেন।

একপর্যায়ে জনকণ্ঠের সব কার্যক্রম স্থগিত করার ঘোষণা দেয় তারা। শুক্রবার রাত থেকে এ নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয় জনকণ্ঠ ভবনে। শেষ পর্যন্ত শনিবার রাতে চাকুরিচ্যুতরা সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাদের নিয়ে একটি সম্পাদকীয় বোর্ড গঠন করে জনকণ্ঠের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

বিবিসি বাংলাকে শামীমা এ খান বলেন, অনেক দিন ধরেই ষড়যন্ত্র করছিল তারা। এখন নিজেরাই কালো রং করে সাবোটাজ করেছে। অথচ আমরা পত্রিকার ব্যানার লালই করেছি। কিন্তু এটাকে ইস্যু করেই তারা পত্রিকা দখলের ষড়যন্ত্র করেছে।

তবে শিশির বলছেন, আমরা মালিক পক্ষের সঙ্গে দুদিন ধরে আলোচনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আসেনি। তারা পত্রিকার ব্যানারে কালো রং ধারণ করে আমাদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। মালিক পক্ষের দুই-তিন জন লোক আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এটি করেছে। সব সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গে বসে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে পত্রিকাটি বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে একটি সম্পাদকীয় বোর্ড দরকার। সেটি করেছি এবং একটাও মামলাও করেছি।

পাঁচ দফা দাবিতে যা আছে-

রবিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিজেদের পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন ইস্রাফিল ফরাজি। এসব দাবি আদায়ে শনিবার প্রায় এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটা অংশ।

তাদের দাবিসমূহের মধ্যে রয়েছে—

জুলাই বিপ্লবে শহীদদের অবমাননা করে পত্রিকাটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কালো টেমপ্লেট ধারণ করার জন্য জড়িত মালিক পক্ষকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

লাল রং ধারণ করে পত্রিকাটি প্রকাশ করার কারণে জুলাই বিপ্লবের পক্ষের চাকরিচ্যুত সকল সাংবাদিককে চাকরিতে সসম্মান পুনর্বহাল করতে হবে।

আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রায় ছয় কোটি টাকা বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে হবে।

এই প্রতিষ্ঠান থেকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত তিন শতাধিক ব্যক্তির পাওনা টাকা অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে এবং

প্রতিষ্ঠানের যেসব পাওনাদার মালিকপক্ষের অমানবিক আচরণের শিকার, তাদের দায় গ্লোব জনকণ্ঠের মালিককে নিতে হবে এবং সব পাওনা পরিশোধ করতে হবে।

১৯৯৩ সালে আতিকউল্লাহ খান মাসুদ পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠার পর এটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে পরবর্তীতে এটি আওয়ামী লীগপন্থি পত্রিকা হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠে বলে অনেকের অভিযোগ।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন