ঢাকা, সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫

২০ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৯ সফর ১৪৪৭

রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা হবে

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় আসছেন

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৩:৫১, ৪ আগস্ট ২০২৫

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় আসছেন

ছবি: সংগৃহীত

প্রায় তিন দশকের ব্যবধানে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সফরে বাংলাদেশে আসছেন। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগামী ২৩ আগস্ট দুই দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছাবেন। এই সফর দুই দেশের মাঝে দীর্ঘদিনের শীতল কূটনৈতিক সম্পর্কের উষ্ণতায় ফেরার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। সফরের দ্বিতীয় দিন তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সফরের সময় ইসহাক দার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এই সফর মূলত সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের ধারাবাহিকতায় হচ্ছে, যেখানে রাজনৈতিক পর্যায়ের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় রয়েছে।

এর আগে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ ঢাকায় এসে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন, যা ছিল প্রায় ১৫ বছরের স্থবিরতার পর সম্পর্ক সক্রিয়করণের প্রথম ধাপ। সেই আলোচনার সূত্র ধরেই এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হতে যাচ্ছে। তবে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচি চূড়ান্ত হয়নি।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ২৩ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দ্বিপক্ষীয় সফরে ঢাকায় আসছেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি হতে পারে ২৪ আগস্ট। আসন্ন ঢাকা-ইসলামাবাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের অগ্রাধিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, এখনো আলোচ্যসূচি ঠিক হয়নি। আশা করছি, আগস্টের শুরুতে তা চূড়ান্ত করা হবে।

ইসহাক দারের সফরকে ঘিরে কূটনৈতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক বার্তা বিনিময়েরও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সূত্র বলছে, তিনি ঢাকায় অবস্থানকালে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারেন। সফরটি মূলত এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন ভারতীয় পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনার পর উদ্ভূত অঞ্চলের উত্তেজনার কারণে তা স্থগিত করা হয়েছিল। পরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে নতুন তারিখ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়।

এই সফরে অমীমাংসিত কিছু ঐতিহাসিক ইস্যু বিশেষভাবে আলোচনায় আসতে পারে বলে বাংলাদেশের সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে তিনটি বিষয়ে সন্তোষজনক অগ্রগতি দেখতে চায়: একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, পাকিস্তানে অবস্থানরত আটকে পড়া নাগরিকদের প্রত্যাবাসন এবং অবিভক্ত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিতকরণ। এসব বিষয়ে পাকিস্তান আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করলেও, পূর্ববর্তী বৈঠকের পর তাদের প্রকাশিত বিবৃতিতে এ প্রসঙ্গগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। এর বিপরীতে, বাংলাদেশ সবসময় এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত শেষ পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকের পরও পাকিস্তান একইভাবে এসব প্রসঙ্গ বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করেনি। এবারো বাংলাদেশ চায় এই ঐতিহাসিক ও সংবেদনশীল বিষয়গুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি হোক, যাতে দুই দেশের সম্পর্ক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থিতিশীল ও গঠনমূলক ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারে। ডি-৮ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস স্পষ্টভাবে বলেন, এসব প্রশ্ন বারবার আসছে এবং এগুলো চিরতরে নিষ্পন্ন করা সময়ের দাবি।

পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়েও দুই দেশ একমত। পাকিস্তান চায়, ইসহাক দারের সফরের পরপরই ইসলামাবাদে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হোক। সর্বশেষ জেইসি বৈঠক হয়েছিল ২০০৫ সালে ঢাকায়। দীর্ঘ ব্যবধানের পর এবার এই কমিশনের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার ব্যাপারে উভয় দেশই আগ্রহ দেখিয়েছে।

ইসহাক দারের সফরে অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে তার সঙ্গে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিও বাংলাদেশে আসছেন। এর আগে, ১৪ জানুয়ারি দুই দেশের ব্যবসায়ী সংগঠন যৌথভাবে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল গঠনের উদ্যোগ নেয়। এরপর ২৮ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘পাকিস্তান-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম’-এ দুই দেশের পোশাক খাতের প্রতিনিধিরা একসঙ্গে কাজের আশাবাদ ব্যক্ত করে এবং বিজিএমইএ ও পিআরজিএমইএর মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।

বাণিজ্যিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯৫৬ মিলিয়ন ডলার; যা আগের বছরের তুলনায় পাঁচ শতাংশ বেশি। তবে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাণিজ্যের পরিমাণ কমেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল এবং সংকটকালে খাদ্যশস্য আমদানি করে। অন্যদিকে, পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট, চা, চামড়া ও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আমদানি করে।

সাবেক কয়েকজন কূটনীতিকের অভিমত, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল চালুর উদ্যোগ, ভিসা নীতিতে নমনীয়তা, এবং পাকিস্তানের দুটি বেসরকারি বিমান সংস্থা— ফ্লাই জিন্নাহ ও এয়ারসিয়ালের— বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পাওয়া।

তবে এসব অগ্রগতি সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এখনো কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা সতর্ক অবস্থানেই রয়েছে। সরকারি পর্যায়ের মতামত অনুযায়ী, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের গভীরতা তখনই কার্যকর হবে যখন ঐতিহাসিক অমীমাংসিত বিষয়গুলোর বাস্তব ও ইতিবাচক সমাধান হবে।

ইসহাক দারের আসন্ন ঢাকা সফর তাই কেবল একটি প্রথাগত কূটনৈতিক সফর নয়; বরং এটি ভবিষ্যৎ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও পুরোনো অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর আলোচনার একটি সম্ভাব্য নতুন সূচনাবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। দুই দেশের সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে এই সফরকে ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ করার প্রত্যাশাও এখন অনেক বেশি।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন