ঢাকা, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মুহররম ১৪৪৭

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি

বাবা! বাবা!… কাল রাতের সেই ডাকটা বুক কাঁপিয়ে দিয়েছে

মোহাম্মদ সবুজ পারভেজ

প্রকাশ: ২০:২৭, ২২ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ০০:২৮, ২৩ জুলাই ২০২৫

বাবা! বাবা!… কাল রাতের সেই ডাকটা বুক কাঁপিয়ে দিয়েছে

আজও যেন থমকে আছে উত্তরার আকাশ। পুরো জাতি যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে উত্তরার ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পর। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও আমি এখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। গা কাঁপছে… বুকের ভেতর জমে আছে এক অজানা ভয়। এই পৃথিবীতে আর এক মুহূর্তও ভালো লাগছে না।

কারণ আমি শুধু একজন সংবাদকর্মী নই—আমি একজন বাবা। গতকাল বিমান দুর্ঘটনার খবর সারাদিন প্রকাশ করার পর রাতে যখন বাসায় ফিরি, তখন সময় রাত সাড়ে ১২টা। আমার একমাত্র ছেলে তালহা পারভেজ, প্রতিদিনের মতো গতকালও তার মা দরজা খোলার আগেই বুঝে যায়, বাবা এসেছে দরজায়। বাসার ভেতর থেকে চিৎকার করে হাসতে থাকে আর বলতে থাকে—“তে? তে? বাবা! বাবা!” দরজার বাইরে তালহার এই কন্ঠ পৌচ্ছাতে কতো ন্যানো সেকেন্ড সময় লেগেছে সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে এটা বলতে পারি ছেলের এই ডাক আমার কানে পৌছাতেই ভেতরটা ছুঁয়ে যায়। সারা দিনের ক্লান্তি যেন এক নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। সত্যি। শেষ হয়ে যায়! কারণ অফিসে বা বাইরে থেকে যে ক্লান্তি অনুভব হয় সেটা তালহার কন্ঠ শোনা মাত্রই হাওয়া হয়ে যায়। জুতা খুলে বাসায় প্রবেশ করার পরই মনে হয়, ঈদের সকালে বাবাকে কাছে পেয়ে তালহার যেন উৎসব শুরু হয়েছে। প্রতিদিন এই একই দৃশ্য দেখি, কিন্তু গতকালকের দৃশ্যটা বুকটা কাঁপিয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছিল, আজকের মতো করে যদি আর কখনো তাকে দেখতে না পাই! কীভাবে আমি এই ছেলেকে রেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো? কিংবা আমি না থাকলে, তালহা কীভাবে আমার অভাবে বাঁচবে? বাবা হয়ে সন্তানের মুখে ঈদের মতো হাসি দেখেও বুকের ভেতরে কেমন যেন এক শূন্যতা জন্ম নিচ্ছিলো।

কিন্তু এই ভাবনাগুলো আরও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে কালকের বিমান দুর্ঘটনার পর। আমি চাই না, এমন ভয়ংকর চিন্তা মাথায় আসুক, কিন্তু কী করে আটকাই? আমি নিজেও একজন বাবা, আর আমি জানি—কোনো বাবা তার সন্তানের কফিন কাঁধে নিয়ে কবর অবধি হাঁটতে পারে না! এটা তো কল্পনাও করতে চাই না আমি। কিন্তু গতকাল, সেই অকল্পনীয় বাস্তবতাই তো চোখের সামনে ঘটেছে।

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের শিশুদের চিৎকার অনুভব করছি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওই মুহুর্তে তাদের সঙ্গে কি ঘটেছে! কিভাবে তারা মা মা করতে করতে পৃথিবী ছেড়েছে! হয়তো বাঁচাও বাঁচাও বলে পৃথিবীতে আরো কিছুটা দিন থাকতে চেয়েছে! খোদার কসম একবারও মাথা থেকে এই ভাবনা নামছে না। বুকের ভেতরটা এখনো ভাইভ্রেট হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না, যারা তাদের কলিজার টুকরাগুলো হারিয়েছেন, সেই বাবা-মা, ভাইবোনেরা এখন কেমন আছেন! কোনো বাবা-মা যেন এমন দৃশ্য জীবনে না দেখেন—এই দোয়া করি, কিন্তু এটাই তো ঘটেছে এই বাংলার বুকে!

গতকাল থেকেই দেশের উপর একরকম ঘৃণা জন্মেছে। কিন্তু ঘৃণার কারণটা খুঁজে পাচ্ছি না। এ কি অব্যবস্থাপনা? উদাসীনতা? অনিয়ম? নাকি দায়হীনতার ভয়াবহ চিত্র? আমি জানি না, এই দেশ কি কোনোদিন এই ক্ষতির ভার কাটিয়ে উঠতে পারবে! কিন্তু আমি নিশ্চিত, যারা হারিয়েছেন, তাদের ক্ষতি কোনো ভাষা দিয়ে পূরণ করা যাবে না। কোনো দিন না।

আরও অবাক হয়েছি, আজ যখন দেখলাম—বিমান বাহিনীর প্রধান বলছেন, “উন্নত বিশ্বের যুদ্ধবিমানও দুর্ঘটনায় পড়ে। এমনকি এফ-৩৫-ও বাদ যায়নি।” কী অদ্ভুত এক মন্তব্য! একজন মানুষ, যিনি একটি দেশের বিমান বাহিনী পরিচালনা করেন, তিনি কীভাবে এতটা সংবেদনহীন হতে পারেন? দুঃখের দিনে, জাতির কান্নার দিনে, শোকের দিনে, কেউ যদি নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে এমন উদাহরণ টেনে আনেন—তবে প্রশ্ন ওঠে, তিনি কীভাবে এত বড় দায়িত্বে আসীন হলেন?

তাঁর এই বক্তব্যে দেশের ‘ভাবমূর্তি’ উজ্জ্বল হলো? নাকি আরও একবার প্রমাণ হলো—দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কীভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর শীর্ষ পর্যায়ে বাসা বেঁধেছে!

অনেকেই বলছেন, প্রকৃত মৃতের সংখ্যা গোপন করা হয়েছে। যদি সত্যিই এমন কিছু ঘটে থাকে, তাহলে আমার প্রশ্ন—এটা কি দেশের ভাবমূর্তিকে রক্ষা করছে, নাকি জাতিকে প্রতারিত করছে?

আমরা কি আসলে সত্য জানতে পারবো? নাকি আমরা আবারও কোনো চিরাচরিত ‘গুমড়ানো সত্য’ নিয়ে বাঁচবো?

এই প্রশ্নগুলোই আজ বার বার আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি জানি না, এই লেখাটি দিয়ে কারো কিছু যায় আসে কি না, কিন্তু আমি শান্তি পাচ্ছি না। একজন সাংবাদিক হিসেবে নয়, একজন বাবা হিসেবে আমি আজ প্রশ্ন তুলতেই পারি—এই মৃত্যুর দায় আসলে কার?

একজন বাবা, একজন সংবাদকর্মী, একজন নাগরিক হিসেবে আমি কাঁপছি...

মোহাম্মদ সবুজ পারভেজ
প্রধান সম্পাদক
ঢাকা এক্সপ্রেস

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ

আরও পড়ুন