ঢাকা, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৬ মুহররম ১৪৪৭

যুক্তরাজ্যে সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তর করছেন ঢাকার ধনকুবেররা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১১:১০, ২০ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ১১:১৩, ২০ জুলাই ২০২৫

যুক্তরাজ্যে সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তর করছেন ঢাকার ধনকুবেররা

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের মুখে পড়া কিছু বাংলাদেশি ধনকুবের বর্তমানে যুক্তরাজ্যে তাদের সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তর বা বিক্রি করছেন। দ্য গার্ডিয়ান এবং দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যা যুক্তরাজ্যের আইনি সংস্থাগুলোর প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাজ্যে বহু লেনদেন এবং সম্পত্তির হস্তান্তর সহজ করতে কিছু আইনি প্রতিষ্ঠান এবং পরামর্শক সংস্থা সাহায্য করেছে, যা নৈতিক ও আইনি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। 

এ নিয়ে গার্ডিয়ান শনিবার (১৯ জুলাই) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গার্ডিয়ান জানিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা, যারা গণঅভ্যুত্থান এবং রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এখন তদন্তাধীন, তারা যুক্তরাজ্যের সম্পত্তি বাজারে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এক বছরের মধ্যে অন্তত ২০টি ‘লেনদেনের আবেদন’ জমা পড়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তিনটি বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং তিনটি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের মালিকানাধীন সম্পত্তি সম্পর্কিত।

বাংলাদেশের গত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটছে, যখন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল এবং দেশের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই সময়ে, ঢাকার তদন্তকারীরা পাচার করা অর্থ এবং বিদেশে নেওয়া সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য যুক্তরাজ্যকে সাহায্য চেয়েছেন।

যুক্তরাজ্যে, বেশ কিছু সম্পত্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত ব্যবসায়ীরা তাদের পাচার করা অর্থ অবলম্বনে জমি কিনেছেন। তবে এখন এই সম্পত্তি নিয়ে তদন্ত চলছে এবং এনসিএ (ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি) ইতোমধ্যে সালমান এফ রহমান ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কিছু সম্পত্তি জব্দ করেছে। বিশেষ করে, গত মে মাসে সালমান এফ রহমানের নয় কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করা হয় এবং তার তিন সপ্তাহ পর সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ১৭ কোটি পাউন্ডের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হয়।

বাংলাদেশের সরকার, বিশেষত দুদক, যুক্তরাজ্যকে আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন আরো বেশি সম্পত্তি জব্দ করে, যাতে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এ ব্যাপারে আরো পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাজ্যকে অনুরোধ করেছেন। একইভাবে, দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনও যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে তদন্তের ব্যাপারে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যে এসব তদন্তের সময়, সম্পত্তি বিক্রির জন্য প্রায় ২০টি আবেদন জমা পড়েছে, যার মধ্যে চারটি সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন। তিনটি বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং আরো তিনটি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের নাম জড়িয়ে রয়েছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, যিনি বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী ছিলেন, তার মালিকানাধীন ৩০০টিরও বেশি বিলাসবহুল সম্পত্তি ছিল, যার মধ্যে অন্তত ১৭ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিল।

এ ছাড়া, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং তার পরিবারের সদস্যরা সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে তাদের কিছু সম্পত্তি হস্তান্তর করেছেন, যার মধ্যে সেন্ট্রাল লন্ডনে অবস্থিত একটি ৮০ লাখ পাউন্ড মূল্যের বাড়ি এবং নাইটসব্রিজের একটি টাউন হাউস রয়েছে। সোবহান পরিবার, যারা সিমেন্ট ও মিডিয়া ব্যবসায় বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করে, তাদের সম্পত্তি এবং লেনদেনগুলি তদন্তের আওতায় এসেছে।

এদিকে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী এবং একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি প্রপার্টি ডেভেলপারও গত এক বছরে একাধিক সম্পত্তি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে, আনিসুজ্জামান চৌধুরী সম্প্রতি লন্ডনের রিজেন্টস পার্কের কাছে এক কোটি পাউন্ড মূল্যের একটি টাউন হাউস বিক্রি করেছেন। এ ছাড়া, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আইনজীবীরা বলছেন, তার বিরুদ্ধে কোনো বৈধ আইনি ভিত্তি নেই এবং তার সম্পত্তি জব্দ করার জন্য যথেষ্ট কারণ পাওয়া যায়নি।

এদিকে, সালমান এফ রহমানের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে গত মাসে তিন কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। তাদের আইনজীবীরা বলছেন, এই অভিযোগগুলির মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে এবং তারা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। যুক্তরাজ্যে এই ধরনের পদক্ষেপের পর, এমন অভিযোগ উঠছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

অন্যদিকে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, আইনি সংস্থাগুলোর জন্য অত্যন্ত জরুরি যে তারা তদন্তাধীন গ্রাহকদের সম্পত্তির উৎস সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করুন এবং কোনো সন্দেহজনক লেনদেন সম্পর্কে পুলিশকে অবিলম্বে জানান। তা না হলে, এই সন্দেহজনক সম্পত্তি আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় বিলীন হয়ে যেতে পারে।

যুক্তরাজ্যের এমপি জো পাওয়েল দুর্নীতি ও কর পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, এই ধরনের তদন্ত দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। ইতিহাস আমাদের বলে, যদি এই তদন্তগুলো দ্রুত না করা হয়, তবে অনেক সম্পত্তি বিলীন হয়ে যেতে পারে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন