ঢাকা, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

৭ আষাঢ় ১৪৩২, ২৪ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

হৃদরোগে মৃত্যু, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান’ হত্যা বলে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক 

প্রকাশ: ১৪:৫১, ২০ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৫:১৮, ২০ জুন ২০২৫

হৃদরোগে মৃত্যু, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান’ হত্যা বলে মামলা

রংপুরে আলোচিত ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান’–কে ঘিরে দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে রংপুর মেট্রোপলিটনের হাজিরহাট থানার পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করে। পরে আদালতের নির্দেশে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।

২০২৪ সালের ২ আগস্ট রংপুর নগরের রাধাকৃষ্ণপুর এলাকায় ছমেস উদ্দিন নামে এক মুদিদোকানি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী আমেনা বেগম চলতি বছরের ৩ জুন রংপুরের হাজিরহাট থানায় স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি মাহমুদুল হককে ৫৪ নম্বর আসামি করা হয়।

এজাহারে অভিযোগ করা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর চিরতরে থামাতে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেই নির্দেশ বাস্তবায়নে ছমেস উদ্দিনকে দেশি অস্ত্র দিয়ে গুরুতর জখম করেন। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত আটটার দিকে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

তবে ছমেস উদ্দিনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তিকর তথ্য। তাঁর কবরের পাশে লাগানো সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, তিনি পুলিশের উপস্থিতি দেখে দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যান এবং সেখানেই স্ট্রোক করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে প্রাইম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের দাবি, ঘটনাটি সাজানো এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, ছমেস ছিলেন হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই তাঁর হার্টে রিং বসানো হয়।

রাধাকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা জামায়াতের সাবেক নেতা নাছির উদ্দিন বলেন, ‘‘পুলিশ সেদিন আমার বাড়িতে হানা দেয়ার আগেই আমি পালিয়ে যাই। রাতে জানতে পারি, ছমেস পালাতে গিয়ে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন। তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে—এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।’’

মামলার বাদী আমেনা বেগমের ছেলে আশিকুর রহমানও জানিয়েছেন, মৃত্যুর সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তবে তিনি জানান, ঘটনাস্থলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা ছিলেন এবং ছমেস দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যান।

এদিকে মাহমুদুল হকের স্ত্রী মাসুবা হাসান অভিযোগ করেছেন, এজাহারে নাম আসার পেছনে ব্যক্তিগত শত্রুতা কাজ করেছে। তাঁর দাবি, ‘‘ওসি সাহেব সাদা কাগজে সই নিয়ে নিজের মতো করে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে ফাঁসানো হয়েছে।’’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সংগঠক ইউশা মোহন রাতুল অভিযোগ করেন, ‘‘আমার বাবাকে যুবলীগ নেতা বানিয়ে মামলায় জড়ানো হয়েছে, অথচ তিনি গেজেটভুক্ত আহত আন্দোলনকারী। এই মামলায় নির্দোষ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে।’’

তিনি বলেন, হাজিরহাট থানার ওসি আবদুল আল মামুন শাহ নিজেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন এবং এতে তাঁর অস্বাভাবিক আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ওসি মামুন শাহ অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তদন্তের ভিত্তিতে সঠিক অভিযোগপত্র আদালতে দেওয়া হবে এবং কোনো নির্দোষকে হয়রানি করা হচ্ছে না।

মাহমুদুল হকের গ্রেপ্তারের ঘটনায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁরা থানায় গিয়ে এর কারণ জানতে চান। শিক্ষার্থীদের দাবি, মাহমুদুল হক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন সমর্থক হিসেবে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তিনি ফেসবুকে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বলেছিলেন। তাঁকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দমন করার চেষ্টা হচ্ছে।’

মামলা, গ্রেপ্তার ও তদন্ত—সবকিছু মিলিয়ে রংপুরে ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান’ ঘিরে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রকৃত সত্য কতটা প্রতিফলিত হয়।

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ

আরও পড়ুন