ঢাকা, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

১ শ্রাবণ ১৪৩২, ২০ মুহররম ১৪৪৭

‘অতিবিপন্ন’ সবুজ সামুদ্রিক কাছিমের দেখা মিলল নাফ নদীর তীরে

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৯:৩৪, ১৬ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ০৯:৫৯, ১৬ জুলাই ২০২৫

‘অতিবিপন্ন’ সবুজ সামুদ্রিক কাছিমের দেখা মিলল নাফ নদীর তীরে

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো নাফ নদীর তীরে একটি চিংড়ি ঘেরে অতিবিপন্ন প্রজাতির সবুজ সামুদ্রিক কাছিমের দেখা মিলেছে। ভাগ্যগুণে নানা হাত ঘুরে বিরল কাছিমটির জীবনও রক্ষা পেয়েছে।

কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বাবিল এলাকায় নাফ নদীর তীরে একটি চিংড়ি ঘেরে ১০ জুলাই সবুজ সামুদ্রিক কাছিমটি ধরা পড়ে।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, সাগর থেকে নাফ নদী হয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে কাছিমটি সেখানে পৌঁছায়।

বাংলাদেশে যে পাঁচ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিমের দেখা মেলে তার মধ্যে সবুজ সামুদ্রিক কাছিম ‘অতিবিপন্ন’। বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক কাছিমের এই প্রজাতিটি ‘বিপন্ন’।

হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বাবিল এলাকায় নাফ নদীর তীরে স্থানীয় আবুল কালামের চিংড়ি ঘের। ঘেরে থেকে চিংড়ি পোনা বেরিয়ে যাওয়া ঠেকাতে বসানো জালে ১০ জুলাই কচ্ছপটি আটকা পড়ে।

কক্সবাজার সাগর উপকূলে কাছিম সুরক্ষায় কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কমিউনিটি ডেভেলেপমেন্ট সেন্টারের (কোডেক) কমিউনিটি লেড টারটেল কনজারভেশন প্রকল্পের রিসার্চ ফ্যাসিলিটেটর মো. লিয়াকত আলী বলেন, সেদিন ঘের মালিক কাছিমটি নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে কাছিমটি একরাত ছিল। পরদিন কাছের বাঘঘোনা গ্রামের পাহাড়ি ছড়ায় তিনি কাছিমটি ছেড়ে দেন। কিন্তু সামুদ্রিক কাছিমটি পাহাড়ি এলাকায় বেশি দূর যেতে পারেনি। ছড়ার নিচে স্থানীয় শিশুরা কাছিমটি নিয়ে খেলায় মেতে উঠে। সেখানে কাছিমটি একদিন ছিল। পরদিন স্থানীয় এক কাঁকড়া ব্যবসায়ী কাছিমটি ছড়া থেকে ধরে নিয়ে আসে। 

তিনি বলেন, বিক্রির জন্য বাজারে নেওয়ার পর আমাদের স্থানীয় রইক্ষ্যং কমিউনিটি পেট্রোলিং টিমের সভাপতি সৈয়দ আলম কাছিমটি দেখতে পান। তিনি আমাদের এবং বন বিভাগকে খবর দেন। পরে বাজার থেকে আমরা কাছিমটি উদ্ধার করি।

কোডেক–কমিউনিটি লেড টারটেল কনজারভেশন প্রকল্পের ফোকাল পার্সন ও কোডেকের পরিচালক ড. শীতল কুমার নাথ বলেন, যখন কাছিমটি উদ্ধার করা হয় তখন এর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। ছড়ায় থাকার সময় শিশুরা কাছিমটি উল্টে দিয়ে খেলা করলেও কোন আঘাত করেনি।

কাছিমটির শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা শেষে ১২ জুলাই উখিয়া উপজেলার মাদারবুনিয়া এলাকার কোডেক হ্যাচারি সংলগ্ন সমুদ্রে অবমুক্ত করা হয়।

এসময় কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম, সহকারী বন সংরক্ষক মনিরুল ইসলাম, হোয়াইক্যং রেঞ্জ কর্মকর্তা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ মিনার চৌধুরী ও বিট কর্মকর্তা সোহেল রানা উপস্থিত ছিলেন।

প্রাণিবিদ ড. শীতল কুমার নাথ বলেন, বাংলাদেশে সবশেষ ১০-১২ বছর আগে সবুজ সামুদ্রিক কাছিম দেখে গেছে। এর মধ্যে আর এই প্রজাতি শনাক্ত হয়নি। ২০২০ সালে কাছিম সুরক্ষায় কোডেক-এর প্রকল্প শুরু হয়। সবশেষ ওই বছর টেকনাফের হাজাম পাড়া সৈকতে একটি মৃত সবুজ সামুদ্রিক কাছিম পাওয়া গিয়েছিল। সেটির শরীরের বেশিরভাগ অংশ কুকুর খেয়ে ফেলেছিল। শুধু খোলসটি পাওয়া যায়।

সমুদ্রের কাছিম নাফ নদী তীরের চিংড়ি ঘেরে কীভাবে এল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই প্রজাতির কাছিম নোনা পানি থাকলে নদীতেও আসে। নাফ নদীতে সাগরের নোনা পানি প্রবেশ করে। মূলত খাবারের সন্ধানে এটি হয়তো নদীতে প্রবেশ করেছিল।

মো. লিয়াকত আলী বলেন, বেশিরভাগ কাছিম প্রজাতির প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত। এটি প্রজননের সময় নয়। আর যে কাছিমটি পাওয়া গেছে সেটির এখনো ডিম পারার বয়স হয়নি।

তিনি বলেন, হয়তো চিংড়ি পোনা খেতে কাছিমটি ঘেরে প্রবেশ করেছিল। তবে নদীর যে অংশের তীরের ঘেরে এটিকে পাওয়া গেছে তা সাগর সংলগ্ন নাফ নদীর প্রবেশমুখ শাহপরীর দ্বীপ এলাকা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে।

সবুজ সামুদ্রিক কাছিমের ইংরেজি নাম Green Turtle এবং বৈজ্ঞানিক নাম Chelonia mydas।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার নিউমারারি অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান বলেন, এই প্রজাতি বাংলাদেশে অতিবিপন্ন এবং সারাবিশ্বে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। টেকনাফে যে কাছিমটি পাওয়া গেছে সেটির ছবি আমি দেখেছি। এটি সবুজ সামুদ্রিক কাছিম। অতীতে আমাদের দেশের সোনাদিয়া, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন সৈকতে এই প্রজাতির কাছিমের দেখা মেলার রেকর্ড আছে।

তিনি বলেন, প্রজনন মৌসুমে অলিভ রিডলি প্রজাতির পাশাপাশি অল্প কিছু গ্রিন টার্টলও ডিম দিতে সৈকতে আসে। কিন্তু ডিম দেখে কাছিমের প্রজাতি শনাক্ত করা যায় না। যেহেতু বেশিরভাগ সময় রাতের বেলায় ডিম পেড়ে কাছিম সাগরে ফিরে যায় তাই এদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।

শীতল কুমার নাথ বলেন, আমরা পাঁচটি হ্যাচারিতে সামুদ্রিক কাছিমের ডিম সংরক্ষণ করি। বাচ্চা ফোটার পর সেগুলো সাগরে অবমুক্ত করা হয়। এরমধ্যে ৯৮ ভাগই অলিভ রিডলি প্রজাতির। অল্প কিছু হয়তো গ্রিন টার্টল থাকে। তবে ডিম বা অল্প বয়সী বাচ্চা দেখে প্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান বলেন, পরিণত বয়সে এই প্রজাতির গায়ে একটা সবুজাভ রঙ আসে। এই প্রজাতির অপ্রাপ্ত বয়স্ক কাছিম এরকম লালচে রঙেরই হয়।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের (ডব্লিউডব্লিউএফ) ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সবুজ সামুদ্রিক কাছিম সাধারণত সমুদ্রের ঘাস ও শৈবাল খায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশান সার্ভিসের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, সমুদ্র ঘাস ও শৈবাল খাওয়ার কারণে এই প্রজাতির কাছিমের সবুজ রঙের চর্বি হয় তাই এর নাম সবুজ কাছিম।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) এর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, অপ্রাপ্তবয়স্ক সবুজ সামুদ্রিক কাছিম সামুদ্রিক ঘাস ও শৈবালের পাশাপাশি অমেরুদণ্ডী প্রাণি, ফেলে দেওয়া মাছ ও মাছের টোপ খেয়ে থাকে।

টেকনাফে উদ্ধার হওয়া কাছিমটির ওজন সাত কেজি ৭০০ গ্রাম এবং এটির বয়স ১০ বছরের কিছু কম-বেশি হতে পারে জানিয়ে ড. শীতল কুমার নাথ বলেন, এই প্রজাতি শতবর্ষী। ১৪-১৫ বছর বয়স হলে অর্থাৎ পরিণত বয়সে এই প্রজাতি ডিম দেয়।

ইউনাইটেড নেশানস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) বাংলাদেশ ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘Sea Turtle Conservation Through Behavioral Insights and Community Engagement’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ডিম দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে আসে অলিভ রিডলি, সবুজ সামুদ্রিক কাছিম এবং হকস বিল প্রজাতির কাছিম।

সবুজ সামুদ্রিক কাছিম মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। অন্যান্য সামুদ্রিক কাছিম প্রজাতির মতো এই প্রজাতিও জীবদ্দশায় জন্মস্থান থেকে বহুদূরের সাগর পথ পরিভ্রমণ করে।

এনওএএ-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, অলিভ রিডলি প্রজাতির মতো সবুজ সামুদ্রিক কাছিম প্রজাতিও সচরাচর যে সৈকতে তাদের জন্ম হয় ডিম পাড়ার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেখানেই ফিরে আসে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন