ঢাকা, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

১১ আষাঢ় ১৪৩২, ২৮ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু, মৃত্যুর হার ভয় জাগাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩:১০, ২৫ জুন ২০২৫

আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু, মৃত্যুর হার ভয় জাগাচ্ছে

ছবি: সংগৃহীত

দিন দিন বাড়ছে ডেঙ্গু। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের সর্বত্র চিকিৎসার সুব্যবস্থা না করলে, রাজধানীতে বাড়বে রোগীর চাপ, তাতে বাড়বে জটিলতা। ডেঙ্গু আক্রান্তের পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুর হার। নেই ডেঙ্গু মৃত্যুর পর্যালোচনা করার কোনো পদক্ষেপ।

অভিযোগ আছে, প্রশাসন ডেঙ্গুকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে কখনো দেখেনি। ডেঙ্গু মোকাবিলায় তাদের আন্তরিকতার অভাবের বিষয়টি সামনে এসেছে বারবার। 

গত ১৮ জুন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মিলনায়তনভর্তি মানুষের সামনে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশীদ বলেন, টাকার অভাবে ডেঙ্গুমৃত্যু পর্যালোচনা (ডেথ রিভিউ) করতে পারিনি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বা তার অধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে টাকার অভাবে জনগুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হতে পারেনি, এমন কথা এত স্পষ্ট করে এর আগে কেউ বলেননি। সিডিসির লাইন ডিরেক্টর যখন টাকার অভাবের কথা বলেছিলেন, তখন তার পাশেই ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর। তিনি হালিমুর রশীদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডেঙ্গুতে মৃত্যু হলে সেসব মৃত্যুর পর্যালোচনা করার কেন দরকার? আর এই দরকারি কাজটি করতে কত টাকা লাগতে পারে?

মৃত্যু পর্যালোচনা বা ডেথ রিভিউ হলো একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়। এর মূল লক্ষ্য থাকে সেই মৃত্যু থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং ভবিষ্যতে একই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। এটি কেবল চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যগত দিক নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত কারণগুলোও বিবেচনায় নেওয়া হয়।  

ডেঙ্গুর মৃত্যু পর্যালোচনা থেকে বেশ কয়েকটি বিষয় জানা যেতে পারে। সংক্ষেপে সেগুলো তুলে ধরা হলো।

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান কারণসমূহ

ক. শক সিনড্রোম (ডিএসএস): ডেঙ্গু মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হলো শক সিনড্রোম। এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে রক্তনালি থেকে রক্তরস (প্লাজমা) বের হয়ে ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে জমা হয়ে রক্তচাপ মারাত্মকভাবে কমে যায়, যা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত করে এবং শেষ পর্যন্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা বন্ধ করে দেয়। ফলে রোগীর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রায় ৭০ শতাংশ শক সিনড্রোমের কারণে হয়। 

খ. তীব্র রক্তক্ষরণ (সিভিয়ার ব্লিডিং): ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের (ডিএইচএফ) একটি জটিলতা হলো রক্তনালি ফেটে গিয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। এটি মস্তিষ্ক, ফুসফুস, পরিপাকতন্ত্র বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে হতে পারে এবং মারাত্মক রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যু হতে পারে। প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা কমে যাওয়ার কারণেও রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ে।

গ. তরলের ভারসাম্যহীনতা (ফ্লুইড ইমব্যালান্স): ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে তরলের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। শরীরে অতিরিক্ত তরল চলে গেলে হার্ট ফেইলের ঝুঁকি থাকে। আবার তরলের অভাব হলে ডিহাইড্রেশন (তরলশূন্যতা) ও শক সিনড্রোম হতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে তরল ব্যবস্থাপনা (ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট) করতে না পারলে এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

দেরিতে হাসপাতালে আসা

ক. অনেক সময় রোগী ডেঙ্গুর গুরুতর লক্ষণগুলো চিনতে পারেন না বা অবহেলা করেন। ফলে হাসপাতালে ভর্তি হতে দেরি হয়। ডেঙ্গুর জ্বর কমে যাওয়ার পর যে জটিল অবস্থা শুরু হয়, তখন শকের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। রোগী বিষয়টি না বুঝে হাসপাতালে আসতে দেরি করেন এবং গুরুতর অবস্থায় পৌঁছান, তখন রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।

খ. প্রাথমিক বা উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শকে চলে যাওয়া রোগীদের উপযুক্ত পরিচর্যা না করে জেলা বা রাজধানীর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ সময় রাস্তাতেই নষ্ট হয় এবং রোগীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা

ক. হাসপাতালে দেরিতে চিকিৎসা শুরু হওয়া বা সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতির অভাবও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিশেষ করে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট ও শক ম্যানেজমেন্টে ত্রুটি থাকলে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে পারে।

খ. অনেক সময় ডেঙ্গুর অন্য রকম বা অপ্রত্যাশিত (অ্যাটিপিক্যাল) লক্ষণ দেখা যায়। অর্থাৎ ডেঙ্গুর পরিচিত লক্ষণগুলো প্রকাশ না পাওয়ায় রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়।

গ. চিকিৎসাসেবায় প্রশিক্ষণের অভাব ও প্রটোকল মেনে না চলাও ডেঙ্গুতে মৃত্যু হওয়ার একটি কারণ।

ঝুঁকিপূর্ণ রোগী চিহ্নিতকরণ

ক. ডেঙ্গুমৃত্যু পর্যালোচনা থেকে জানা যায়, কোন ধরনের রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেশি। যেমন যারা আগে ডেঙ্গুর অন্য কোনো সেরোটাইপ (ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ বা ধরন আছে—ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ডেন-৪) দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের সংক্রমণে জটিলতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে।

খ. যাদের দীর্ঘমেয়াদি অন্যান্য অসুস্থতা (যেমন কিডনি, হার্ট, লিভারের সমস্যা বা ক্যানসার) আছে, তাদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু আরো বেশি মারাত্মক।

মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কার্যকারিতা

মৃত্যু পর্যালোচনা থেকে পরোক্ষভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কার্যকারিতা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। যদি কোনো এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হয়, তবে বুঝতে হবে, সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা দুর্বল।

ডেঙ্গুমৃত্যু পর্যালোচনা ডেঙ্গুর জটিলতা, চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বলতা, জনসচেতনতার অভাব ও মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এসব তথ্য ভবিষ্যতে ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুহার কমানোর জন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, জ্বরে আক্রান্ত রোগীর এক পরীক্ষাতেই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। 

জনস্বাস্থ্য ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, দেশে প্রতি বছরই ডেঙ্গু সংক্রমণ হওয়ায় এ বিষয়টি সম্পর্কে জনগণ ও চিকিৎসকরা জানেন। আইইডিসিআরের সাবেক এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, আগের ধারাতেই সব হলে ডেঙ্গু সামলানো কঠিন হবে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরই/আরইউ

আরও পড়ুন