শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:১১, ২৪ জুন ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ মাসে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৪ জন। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৮৩ জন।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পৃথক তথ্যে দেখা যায়, গত আট মাসেই নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৫০ জন এবং আহত হয়েছেন আরো ৩৬৩ জন। এমএসএফ-এর ওয়েবসাইটে নভেম্বর ও ডিসেম্বরের হিসাব না থাকলেও ২০২৩ সালের জন্য সংস্থাটির প্রতিবেদন বলছে, ১৪৩টি ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৮৬ জনের। এই পরিসংখ্যানগুলোই জানান দিচ্ছে, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।
তবে বিষয়টি শুধু জনতার হাতে সাধারণ মানুষ বা অপরাধী বলে চিহ্নিত ব্যক্তির নিগ্রহেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বরং সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এর শিকার হচ্ছেন।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ১০ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় হয়েছে ৪৭৭টি মামলা। ২০২৪ সালের আগস্টে ৪১টি, সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪টি, নভেম্বরে ৪৯টি, ডিসেম্বরে ৪৪টি, জানুয়ারিতে ৩৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি, মার্চে ৯৬টি, এপ্রিলে ৫২টি এবং মে মাসে ৬২টি মামলা হয়েছে। অর্থাৎ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেই চলেছে।
গণপিটুনির সর্বশেষ নজির সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে যা ঘটেছে। গত রবিবার রাজধানীর উত্তরায় তার বাসায় ঢুকে একদল মানুষ তাকে জোরপূর্বক টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে এনে পুলিশের কাছে তুলে দেয়। ঘটনার পেছনে বিএনপির ভিন্নমতধারার একটি অংশ এবং তাদের সহযোগী কিছু নেতাকর্মী জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, বিএনপির দায়ের করা একটি মামলায় তার নাম আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে।
ঘটনার সময় বাসার দারোয়ান ফেরদৌস হাসান জানান, সন্ধ্যা ৬টার দিকে ৪০-৪৫ জনের একটি দল বাসার গেট খোলা পেয়ে হঠাৎ ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারা হুদাকে বলে, তার নামে মামলা হয়েছে এবং তাকে নিরাপত্তা দিতে তারা এসেছে। পরে তাঁকে জোরপূর্বক নিচে নামিয়ে আনা হয়।
এই ঘটনার পরপরই পুলিশ জানায়, তারা কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে। উত্তরার স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল ও স্থানীয় বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে এই হামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব মো. হানিফ, যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তোহা ইসলাম মুন্না এবং মোজাম্মেল হক ঢালী, যিনি হুদার গলায় জুতা পরিয়ে মুখে চড় মারেন বলে অভিযোগ।
ঘটনার পর মোজাম্মেল হক ঢালী এক বেসরকারি টেলিভিশনকে বলেন, নূরুল হুদার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেয়ে তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। পরে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে কোনো মারধরের কথা তিনি অস্বীকার করেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শেখ ফরিদ হোসেনও দাবি করেন, উত্তেজিত জনতা হুদাকে আটক করার পর দলীয় কর্মীরা সেখানে গিয়ে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন। এ সময় কেউ তাকে মারধর করেনি বলেও তিনি দাবি করেন। তবে এসব বক্তব্য ভিডিও ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে ভিন্ন।
রবিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, যারা মব সৃষ্টির মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, নূরুল হুদার সঙ্গে যা হয়েছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হামলাকারীদের শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মহিদুল ইসলাম জানান, ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, দুই-আড়াইশ লোক ছিল। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টিম ঘটনাস্থলে যায়। তিনজন পুলিশ সদস্যের পক্ষে এত মানুষের ভিড়ে কী করা সম্ভব ছিল?
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশের উপস্থিতিতে যদি কেউ নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে রাষ্ট্রে আইনের শাসনের প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, মব হলো সংক্রামক ব্যাধির মতো। এখনই যদি এটিকে কঠোরভাবে দমন করা না হয়, তাহলে যে কেউ এর শিকার হতে পারে। তার মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সরকারকে মব সন্ত্রাস প্রতিরোধে জোরালোভাবে চাপ দেওয়া।
মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশের মানুষ আশাবাদী ছিল, একটি ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠবে। কিন্তু ১০ মাস পরেও যদি একজন মানুষকে এভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তাহলে সেটা অরাজকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেটির নিষ্পত্তি হওয়া উচিত সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে। মব সন্ত্রাস কেবল ব্যক্তি অধিকারই লঙ্ঘন করে না, বরং রাষ্ট্রের আইন ও মানবাধিকারের ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) বলেছে, কোনো অপরাধের বিচার হোক প্রচলিত আইনের ভিত্তিতে, তা না করে বিচারবহির্ভূত উপায়ে কারো গায়ে হাত তোলা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ উদাহরণ। সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি এই সংস্থা যথাযথ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে।
মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকার একাধিকবার কঠোর বার্তা দিলেও বাস্তবতার প্রতিফলন মিলছে না। বরং দলীয় বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে বিচারবহির্ভূত প্রতিশোধ, ব্যক্তিগত হেনস্তা, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেও সহিংসতা— এসব আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে এক ভয়ানক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিচারহীনতা আর রাজনৈতিক প্রশ্রয় যদি এই সংস্কৃতিকে আরো উসকে দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে এর শিকার হতে পারে যেকোনো সাধারণ মানুষ।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ