শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:৩৩, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৪.৮ মিলিয়ন শিশু কোনো না কোনো শ্রমের সঙ্গে যুক্ত, যার মধ্যে ১.২ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। তারা ইটভাটা, গার্মেন্টস, ওয়ার্কশপ, বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকা, চা দোকানে কর্মচারী কিংবা কৃষি খাতে কায়িক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। এক গবেষণা বলছে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৩.৫৪ মিলিয়ন শিশু শ্রমে নিয়োজিত, যা মোট শিশু জনসংখ্যার ৮.৯%।
যেসব শিশুরা বাসাবাড়িতে কাজ করে, তাদের জীবনের গল্প আরও ভয়াবহ। সকাল থেকে রাত অবধি কাজ, মালিকের খিটখিটে মেজাজ সহ্য করা, সামান্য ভুলের কারণে গালাগাল বা মারধর—এটাই তাদের প্রতিদিনের চিত্র। কেউ কেউ আবার ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়, যেটা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
শহর ও গ্রামাঞ্চলে পরিবহন ওয়ার্কশপ, গ্যারেজ, সিএনজি ফিটিং, ঢালাই কারখানাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে হাজার হাজার শিশু প্রতিদিন জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অল্প বয়সী শিশুরা কাজ করছে ভারী যন্ত্রপাতির সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে।
জানা যায়, এসব ওয়ার্কশপে কর্মরত শিশুদের বেশিরভাগের বয়সই ৮ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ধোয়ামোছা থেকে শুরু করে চাকায় হাওয়া দেওয়া, সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া-সবই করতে হয় তাদের। অথচ দিন শেষে মজুরি মাত্র ১০০-১৫০ টাকা, কিংবা মাসিক বেতন সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা।
শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য। যারা প্রতিদিনের খাবারের নিশ্চয়তা পায় না, তাদের কাছে শিক্ষা বিলাসিতা মনে হয়। পরিবারগুলো যখন দেখছে, বাবা-মায়ের আয় সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়, তখন সন্তানদের কাজ করতে পাঠানো তাদের কাছে একমাত্র সমাধান মনে হয়। অনেকে মনে করে, ‘আমাদের সন্তান কাজ করলে সংসার চালানো সহজ হবে।’ কিন্তু তারা হয়তো বুঝতে পারে না, শিশুশ্রম তাদের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
শিক্ষার সুযোগের অভাবও শিশুশ্রম বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। যদিও বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে, তবুও এখনও ৪৭% শ্রমজীবী শিশু স্কুলে যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে, বিদ্যালয়ের পরিবেশ, গরিব পরিবারের টানাটানি, শিক্ষকদের অসহযোগিতা-সব মিলিয়ে শিশুরা ঝরে পড়ে।
শিশুশ্রমের আরেকটি বড় কারণ হলো সহজলভ্য সস্তা শ্রমের প্রতি সমাজের নির্লিপ্ততা। অনেকেই শিশুদের কাজ করানোকে অন্যায় মনে করে না, বরং সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়। যে কারণে অনেক মালিকপক্ষ নির্দ্বিধায় শিশুদের কম বেতনে নিয়োগ দেয়। আমাদের সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে শিশুশ্রম কখনোই পুরোপুরি নির্মূল হবে না।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়ন করেছে, যেখানে ১৪ বছরের নিচে শিশুদের কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ১৮ বছরের নিচে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, এই আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতার কারণে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
একজন শিশু যখন প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করে, তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তারা নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পায় না, বিশ্রামের সুযোগ নেই, ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, যা তাদের কর্মদক্ষতাসহ আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়। এছাড়া, যারা অল্প বয়সে কাজ করতে বাধ্য হয়, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। তারা চুরি, মাদক ব্যবসা, কিংবা অন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। কারণ সমাজ যখন তাদের শিক্ষার সুযোগ দেয় না, তারা তখন বিকল্প পথ খোঁজে।
শিশুশ্রম বন্ধে কেবল আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয়-এটা বারবার উঠে আসছে শিশু অধিকার কর্মীদের বক্তব্যে। তারা মনে করেন, এ সমস্যার টেকসই সমাধান পেতে হলে আইনের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং শিশুদের জন্য নিরাপদ বিকল্প কর্মসংস্থান ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করাও জরুরি।
অধিকারকর্মীদের মতে, ওয়ার্কশপ ও কলকারখানাগুলোকে যেহেতু কোনও না কোনও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে চালাতে হয়- বিশেষ করে সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়, তাই এসব প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রম বন্ধে প্রশাসনিকভাবে কিছু শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। যেমন, ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের সময় যদি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় শিশুদের নিয়োগ করা যাবে না, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো একটি স্পষ্ট বার্তা পাবে-শিশুদের বিষয়ে সংবেদনশীল হতে হবে।
তারা আরও বলেন, কোথাও শিশুশ্রমের ঘটনা ঘটলে শ্রম অধিদফতর বা কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের উচিত-দ্রুত মামলা দায়ের করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এমন একটি বার্তা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও সচেতন হয় এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।