শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৫১, ১৩ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১১:০২, ১৩ জুন ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
সরকারি ও বিএনপির সূত্রগুলো জানিয়েছে, এই বৈঠকে দুই পক্ষের আরো কেউ কেউ উপস্থিত থাকতে পারেন। ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে লন্ডনে পৌঁছেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির আরো কয়েকজন নেতাও থাকতে পারেন। তবে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান একান্তে কিছু সময় কথা বলবেন বলে বিএনপি ও সরকারি সূত্র থেকে জানা গেছে।
বৈঠক শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে লন্ডনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ব্রিফিং করতে পারেন বলেও জানা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে লন্ডনে অবস্থানরত তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বার্তায় বলেন, একটা ওয়ান টু ওয়ান মিটিং হবে। এ ক্ষেত্রে উনারা (ইউনূস ও তারেক) যদি মনে করেন আরো কেউ থাকবেন, সেটি দুই লিডারই ডিসাইড করবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠকটি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে যে মতবিরোধ এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটির সমাধানে এই সংলাপ একটি সম্ভাব্য মোড় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে বলে তাদের অভিমত।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিএনপি আশাবাদী, এই আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবেশে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছাবে এবং নির্বাচন ঘিরে যে উত্তেজনা ও জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। তার ভাষায়, সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে, এই বৈঠক বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে, অনেক অচলাবস্থা সহজ হয়ে যেতে পারে, এবং একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন হতে পারে।
উল্লেখ্য, বিএনপি, তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো এবং বাম গণতান্ত্রিক জোট দীর্ঘদিন ধরে ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা বলছে, রমজান, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, ধান কাটা এবং বর্ষার সময় বিবেচনায় ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন আয়োজন বাস্তবসম্মত। অথচ, অধ্যাপক ইউনূস সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের পর আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে।
এই ঘোষণার পরপরই বিএনপি এবং বামজোট তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। তারা অভিযোগ করে, একটি নিরপেক্ষ সরকারের নামে অধ্যাপক ইউনূস একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছেন এবং অধিকাংশ দলের মতামত উপেক্ষা করে নিজস্ব অবস্থানকে নিরপেক্ষতা বলে দাবি করছেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোট তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানায়, ডিসেম্বরের মধ্যে জনগণ ও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে। তারা মনে করে, ২০২৬ সালের এপ্রিল একটি ঝুঁকিপূর্ণ সময় এবং এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার মতো নয়।
এই বিতর্ক ও উত্তেজনার মধ্যেই লন্ডনে ইউনূস-তারেক বৈঠকের খবর সামনে আসে। এর ঠিক আগে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের এক আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলের নেতাদের স্পষ্ট বার্তা দেন— বিতর্ক নয়, নির্বাচন দরকার এবং সংঘর্ষ এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। তিনি অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সহযোগিতার মনোভাব বজায় রাখার পরামর্শ দেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে দেখছেন খালেদা জিয়ার কৌশলী প্রজ্ঞার প্রকাশ হিসেবে, কারণ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেছে নিলে রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হতো এবং দেশ আরো অস্থিতিশীল হয়ে উঠতো।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, এই বৈঠক বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর পথ দেখাতে পারে। তার মতে, বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব কমানো এখন সময়ের দাবি। বেগম জিয়ার নির্দেশনায় বিএনপি একটি সংঘর্ষহীন আলোচনার পথে আগাতে চাচ্ছে— এটি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। এই বৈঠক হতে পারে ‘ব্রেকিং দ্য আইস’, নতুন যাত্রার সূচনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ বলেন, এই বৈঠক দীর্ঘ প্রস্তুতির ফসল। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আলোচনা থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে এবং এপ্রিলের পরিবর্তে নির্বাচন সময় কিছুটা এগিয়ে আনা হতে পারে। তার মতে, প্রতিপক্ষ দলগুলোর প্রতিক্রিয়ায়ও এখন তুলনামূলকভাবে নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে, যা বৈঠকের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করছে।
বিএনপির পক্ষ থেকেও আশাবাদী মনোভাব প্রকাশ করা হয়েছে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, এই বৈঠক জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার এবং গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, দেশের সরকারপ্রধান এবং দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধানের মধ্যে বৈঠকটি হচ্ছে। আমরা আশা করি এবং জাতিরও প্রত্যাশা, এই বৈঠকে জাতির জন্য দিকনির্দেশনামূলক এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে ইতিবাচক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত আসবে।
কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, বৈঠকের সফলতা অনেকটাই নির্ভর করছে অধ্যাপক ইউনূসের অবস্থানের ওপর। তিনি বলেন, যদি ইউনূস সাহেব ডিসেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা দেন, তবে আলোচনাটি ফলপ্রসূ হবে। অন্যথায় সংকট আরো গভীর হবে। তিনি জোর দেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও ২০২৪ সালের ঘটনাগুলোর বিচার কার্যকরভাবে দৃশ্যমান করতে হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এপ্রিল মাসে নির্বাচন ঝুঁকিপূর্ণ। তার মতে, ডিসেম্বর বা ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব এবং সেটি নিয়েই আলোচনায় অগ্রগতি আশা করা যায়। তিনি আরো বলেন, সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণ যদি চলতে থাকে, তাহলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এই সংকটের মূল হচ্ছে নির্বাচনের তারিখ। এই বিষয়ে একটি সমাধান হলে অন্য বিষয়গুলো অনেক সহজ হয়ে যাবে। তিনি যোগ করেন, এই সমাধানের জন্য কাউকে ছোট হতে হবে না, শুধু সমঝোতার মনোভাব থাকতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বৈঠকটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। দলটির যুগ্ম আহবায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে এই বৈঠকটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। কিন্তু বৈঠকটি ইতিবাচক হবে কিনা তা বৈঠকে হওয়া আলোচনার ওপর নির্ভর করবে। যদি শুধু নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়, আর প্রধান উপদেষ্টা যে রোডম্যাপ এরই মধ্যে দিয়েছেন তা যদি বিএনপির দাবি অনুযায়ী এগিয়ে আনা হয় তাহলে আমরা বলব, বিএনপির দলীয় এজেন্ডার কাছে অন্তর্বর্তী সরকার নতি স্বীকার করেছে। কিন্তু যদি কী কী সংস্কার হবে এবং কীভাবে হবে, জুলাই সনদটা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে এসব প্রশ্নে আলোচনা হয় এবং একটি ভালো বোঝাপড়া তৈরি হয়, তাহলে বলা যাবে বৈঠকটির সুফল সুদূরপ্রসারী হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান মনে করেন, এই গুরুত্বপূর্ণ সময় বিএনপিকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচন, রাষ্ট্র সংস্কার ও রাজনৈতিক রূপরেখা নিয়ে স্পষ্ট আলোচনা হওয়া উচিত এবং তারা আশা করছেন, সেই অগ্রগতি বৈঠকে পরিলক্ষিত হবে।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ