ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

১২ বৈশাখ ১৪৩২, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৬

পহেলা বৈশাখে যে কারণে পান্তা খাবেন

লাইফস্টাইল ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩:০২, ১৩ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ১৪:১৭, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

পহেলা বৈশাখে যে কারণে পান্তা খাবেন

পান্তা ভাত বাঙালিদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। যদিও পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তা খাওয়া শহুরে জীবনে নতুন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এটি আসলে সারা বছর ধরেই বাংলাদেশে প্রচলিত একটি খাবার।

পান্তা শুধু একটি খাবার নয়, এটি আমাদের শরীরের জন্যও বেশ উপকারী। এতে ভিটামিন বি বিদ্যমান। তবে এই ভিটামিনের পরিমাণ এবং উৎস নির্ভর করে পান্তা তৈরির পদ্ধতির ওপর, বিশেষত ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ার ওপর। সাধারণভাবে, সাদা ভাতে ভিটামিন বি-এর পরিমাণ কম থাকে। কিন্তু যখন ভাত ফারমেন্ট করা হয়, তখন ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য অণুজীবের কার্যকলাপের ফলে ভিটামিন বি-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। 

পান্তা ভিটামিন বি’র এক অনন্য উৎস-

কাঁচা চালে, বিশেষ করে যে চালে আঁশ থাকে, যেমন থায়ামিন (বি১), নিয়াসিন (বি৩), প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (বি৫) এবং পাইরিডক্সিন (বি৬) এর মতো ভিটামিন বি কমপ্লেক্স পাওয়া যায়। তবে, যখন সাদা চাল তৈরি করা হয়, তখন এই ভিটামিনগুলোর বেশিরভাগ অংশই চলে যায়। কিন্তু পান্তা তৈরির সময় যে ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়া ঘটে, সেখানে ল্যাকটোব্যাসিলাস, পেডিওকোকাস এবং স্যাকারোমাইসিসের মতো অণুজীব ভাতের শর্করা এবং অন্যান্য উপাদান ভেঙে ভিটামিন বি তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভিটামিন বি১, বি৬ এবং বিশেষত ভিটামিন বি১২ উৎপন্ন হতে পারে।

কোন কোন ভিটামিন বি আর কি পরিমাণে থাকে-

থায়ামিন (বি১): সাধারণ ভাতে প্রতি ১০০ গ্রামে ০.০৭০.৪ মিলিগ্রাম থায়ামিন থাকে। আঁশযুক্ত চালে এর পরিমাণ বেশি থাকে, তবে সাদা চালে কম। পান্তা তৈরির সময় ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় থায়ামিনের পরিমাণ সামান্য বাড়তে পারে, প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ।

নিয়াসিন (বি৩): সাধারণ ভাতে নিয়াসিনের পরিমাণ ১.৬৪.৩ মিলিগ্রাম। ফারমেন্টেশনের সময় জৈব প্রক্রিয়া বৃদ্ধির কারণে এটি কিছুটা বাড়তে পারে, তবে নতুন করে উৎপন্ন হয় না।

পাইরিডক্সিন (বি৬): সাধারণ ভাতে ০.১০.৫ মিলিগ্রাম পাইরিডক্সিন থাকে এবং ফারমেন্টেশনের ফলে এর পরিমাণ সামান্য বৃদ্ধি পায়।

ফোলেট (বি৯): পান্তা ভাতের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর ফোলেটের পরিমাণ বৃদ্ধি। ফারমেন্টেশনের সময় অণুজীবের কার্যকলাপের ফলে ফোলেটের পরিমাণ ২০ থেকে ২৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

ভিটামিন (বি১২): সাধারণত ভাতে ভিটামিন বি১২ পাওয়া যায় না, কারণ এটি মূলত প্রাণিজ উৎস থেকে আসে। তবে, কিছু নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় ভিটামিন বি১২ উৎপন্ন করতে পারে, যদিও এর পরিমাণ খুবই সামান্য থাকে, প্রায় প্রতি ১০০ গ্রামে ০.০১০.০৫ মাইক্রোগ্রাম।

সুতরাং, যদিও পান্তা ভাত ভিটামিন বি-এর প্রধান উৎস নয়, তবে ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ার কারণে সাধারণ ভাতের তুলনায় এর পুষ্টিগুণ এবং শরীরে ভিটামিন শোষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ফোলেটের পরিমাণ বৃদ্ধিতে পান্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আসুন জেনে নিই এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কী বলে- 

ফারমেনটেশনের প্রভাব: ‘ফুড সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন’ (২০২০) জার্নাল জানায়, ফারমেনটেড চালে ভিটামিন বি৯ বা ফোলেট এবং বি১২ সংশ্লেষণ হয়। তবে এটি অণুজীবের প্রকার ও ফারমেনটেশন সময়ের ওপর নির্ভর করে। ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা ফারমেনটেশনে এগুলো সর্বোচ্চ হয়। ‘জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ফুড কেমিস্ট্রি’ (২০১৮) অনুসারে, ফারমেনটেশনে ফাইটিক অ্যাসিড কমে যাওয়ায় ভিটামিন বি-এর শোষণ ১ হাজার ৫২৫ শতাংশ বাড়ে। ‘অ্যাপলায়েড মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি’ (২০১৬) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া ফারমেনটেড খাবারে অল্প পরিমাণে বি১২ তৈরি করতে পারে, যা পান্তাভাতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

উপকারিতা: 

বি১, বি৩ এবং বি৬ কার্বোহাইড্রেটকে শক্তিতে রূপান্তরে সহায়তা করে।
বি৯ বা ফোলেট এবং বি১২ লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে কাজ করে এবং এটি রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সহায়ক।
বি৬ এবং বি১২ স্নায়ুস্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

পান্তা পেটের অস্বস্তি দূর করে, পেটের প্রোবায়োটিকস বাড়ায় -

পান্তা ভাত ভিটামিন বি-এর একটি সহায়ক উৎস, বিশেষত ভিটামিন বি১, বি৬, বি৯ এবং সামান্য পরিমাণে বি১২। ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ার কল্যাণে এই ভিটামিনগুলোর পরিমাণ এবং আমাদের শরীরে তাদের গ্রহণ করার ক্ষমতা সাধারণ ভাতের চেয়ে উন্নত হয়। তবে এটা মনে রাখা জরুরি যে, পান্তা ভাত ভিটামিন বি-এর প্রধান উৎস নয়। এই ভিটামিনের দৈনিক চাহিদা পূরণ করার জন্য মাছ, ডিম, ডালের মতো অন্যান্য খাবার গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। 

যদি আঁশযুক্ত চাল ব্যবহার করে সঠিকভাবে পান্তা তৈরি করা হয় এবং ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়, তবে ভিটামিন বি-এর উপকারিতা তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া যায়। এমনকি, মাটির পাত্রে পান্তা তৈরি করলে তা আরও বেশি স্বাস্থ্যকর হতে পারে। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ গ্রামের বেশি পান্তা খাওয়া উচিত নয়।

বৈশাখের সকালে পান্তা খাওয়া একটি আনন্দময় ঐতিহ্য। তবে এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জেনে খাওয়া ভালো। শুধু বৈশাখের প্রথম দিনই নয়, গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন সকালের নাস্তায় পান্তা একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প হতে পারে। ভিটামিন বি-এর অভাব পূরণে পান্তা হতে পারে একটি সহজলভ্য এবং নিরাপদ উপায়, তবে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

ঢাকা এক্সপ্রেস/বিডি

আরও পড়ুন