শিরোনাম
রিপন ইসলাম শেখ, নীলফামারী
প্রকাশ: ১৮:২৯, ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৩৫, ১৬ এপ্রিল ২০২৫
তিস্তা যেন নদী নয়; ধু ধু বালুচর । ছবি: ঢাকা এক্সপ্রেস
তথ্যমতে, ২০২২ সালে ছোট-বড় বন্যা দেখা দিয়েছে ৬ বার। বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে ৩ বার, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়েছে ২ বার ও বিপদ সীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে ১ বার। এ ছাড়া ২০২৩ সালে বন্যা হয়েছে ১২ বার। এরমধ্যে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে ৬ বার, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়েছে ৪ বার ও ২ বার বিপদসীমার কাছাকাছি। অগণিত মানুষকে হারাতে হয়েছে বসত ভিটা, বাসস্থান ও হাজার একর আবাদী জমি বিলিন নদী গর্ভে।
তিস্তার বুক জুড়ে যেখানে-সেখানে ভেসে উঠেছে বিশাল বালুর চর(স্তূপ)। সেই স্তূপ গুলো সমতলের চেয়ে উচ্চতা নিয়েছে বেশি। স্তূপের ফলে গতিপথ হারায় নদী ও নদীর মোহনা। ফলে সমতলে উঠছে পানি। অন্যদিকে ভারতে হঠকারিতা তো আছেই। বিনা নোটিশে যখন তখন ছাড়ছে বাঁধের গেট। ফলে দেখা দিচ্ছে ছোট-বড় বন্যা। প্রতি বছর হারাতে হচ্ছে বসত ভিটা, বাসস্থান ও হাজার একর আবাদী জমি।
সম্প্রতি নীলফামারীর চরাঞ্চলে গিয়ে এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিকাজ ও মাছ ধরাই তাদের জীবন জীবিকার উৎস। ধান, ভুট্টা,গম, আলু, পেঁয়াজ নানান রকম সবজি তারা চাষ করেন। নিজেরা যা চাষ করেন তাই পরিবারের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের চাহিদা খুব বেশি নয়। মোটা কাপড় আর মোটা ভাত পেলেই খুশি তারা।
কিন্তু কিছু কিছু বিষয় তাদের কষ্ট ও দুর্ভোগের কারণ। তার মধ্যে একটি হলো- ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন না এলাকায় স্কুল না থাকার কারণে। ছোট থাকতেই ছেলেকে বাবার সাথে কাজে পাঠানো হয়। মেয়েরা বড় হতে থাকে গৃহস্থালি কাজকর্ম করতে করতে।
গ্রামে কোনো রাস্তা না থাকায় চলাচল করে না কোনো গাড়ি। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করা হয়। দুর্গম এই চর থেকে শহরে যাওয়ার মাধ্যম নৌকা, ঘোড়ার গাড়ি ও ঘাটে যেতে হয় পায়ে হেঁটে। যেটি চলে খেতের মধ্যে দিয়েই। বৃষ্টি হলে কর্দমাক্ত হয়ে হেঁটে চলাচল করাই দায় হয়ে যায়।
কথা হয় ডিমলা উপজেলার বাইশপুকুর গ্রামের গৃহবধূ সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৯৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার সংসার জীবনে প্রথম বন্যা দেখা মিলে ১৯৯৬ সালে। বিলীন হয়ে যায় কিসামত সতীঘাট নামে একটি গ্রাম। সেই থেকে শুরু বাড়ি ভাঙন। পর্যাক্রমে সংসার জীবনে সতেরো বার সরাতে হয়ে বাড়ি। জীবন থেকে হারিয়েছে জীবন সঙ্গী। সংসারে নেমে আসে অচমকা কালো অধ্যায়। জমিজমা বিলীন হয়ে পাঁচ সন্তানের রুটি রুজি জোগাতে হিমশিম অবস্থা তার। একদিকে স্বামী হারার শোক, অন্যদিকে আশ্বিন মাসিয়া মঙ্গা। একবেলা খাবার জুটলেও দুবেলা না খেয়ে থাকতে হয়ে তাদের।
তিনি জানান, তার মতো সেই বন্যায় হাজার-হাজার পরিবার হারিয়েছে বসতবাড়ি। হারিয়েছে শেষ সম্বলটুকুও। তবে, আশা ছাড়েননি সুফিয়া খাতুন। কবে জানি ফিরে পাবে তাদের হারানো সেই সম্পদ। ফিরে যাবে সন্তানকে নিয়ে বাপ-দাদার বসত ভিটাতে।
চর খড়িবাড়ী গ্রামের তারাজুল ইসলাম বলেন, এ এলাকার মানুষ তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর কথা চিন্তাও করতে পারেন না। বছরের ছয় মাস বর্ষা আর নদী পানি পাড়ি দিতে হয় তাই কেউ ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে চায় না। জীবনের ঝুঁকি থাকে সব সময়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ সব দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। এ এলাকার উন্নয়ন করা খুবই জরুরী। কিন্তু কেউ এলাকা নিয়ে ভাবেনা। তিনি এ এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র করার দাবি জানান।
জেলার জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাস্তা না থাকায় সবজি মাথায় করে নৌকাঘাটে আনতে হয়। এরপর এক মণ সবজি বাজার নিতে খরচ পড়ে ১০০-১৫০ টাকার মতো। বাজারে খাওয়া খেতে আরও একশ টাকা খরচ হয়। সবজি বিক্রি করে যে টাকা পান তাতে খরচ ওঠে না।
নদী বিশ্লেষক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী জানান, ২৯০ বছর ধরে তিস্তার কোনো পরিচর্চা নেই। ভারত একতরফা ভাবে পানি নিয়ন্ত্রণ করছে ফলে নদীটির বাংলাদেশ অংশ মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। তিস্তা কেবলমাত্র মৌসুমী নদীতে পরিণত হয়েছে, তিস্তাকে বারোমাসি নদী বলা যাবে না। বর্ষায় যে পলি আসে তাতে নদীর ভূগর্ভ সমতলের সমান উচু হয়ে গেছে। তিস্তায় চ্যানেল একটা না, চ্যানেল এখন অনেক হয়ে গেছে। ভারত যখন পানি ছাড়ে তখন পানি বিভিন্ন চ্যানেলে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা ভৌগলিক রাজনীতিতে পড়ে গেছি। একদিকে চীন চাচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা, অন্যদিকে ভারত বাস্তবায়ন নিজের হাতে রাখতে চাচ্ছে। নিজেদের অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দাবি জানিয়েছি।
তিস্তার বন্যায় সহনুভূতি আর ত্রাণের চেয়ে বড় ভূমিকা হয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা কিংবা নদী শাসন। দ্রুত সময়ে ড্রেজিং এর মাধ্যমে ভূ-গর্ভে বালি অপসরণ। অপর দিকে মহা-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এসএ