শিরোনাম
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২১:০৬, ২৩ জুন ২০২৫
তাহলে তেহরানের ইউরেনিয়ামের মজুতের কী হলো? যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষতি আদতে কতটা করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্র গত শনিবার দিবাগত রাতে ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। সুপরিকল্পিত ওই অভিযানের মাধ্যমে দেশটি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযানের ফলে এমন এক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক সংঘাত আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যখন গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস হামলা অব্যাহত রয়েছে। গতকাল রোববার ভোরে টেলিভিশনে এক ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের হুমকি ঠেকানোর লক্ষ্যে এই হামলা চালানো হয়েছে।
হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল দেশটির নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনা—যেখানে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন বা মজুত রাখা হয় বলে ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্ব দাবি করছে।
পাল্টা হামলার বিরুদ্ধে তেহরানকে সতর্ক করে ট্রাম্প আরও বলেন, ‘আজ রাতেই আমি বিশ্বকে জানাতে পারি, এই হামলা ছিল ‘অসাধারণ এক সামরিক সাফল্য’। ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।’
ইসরায়েল ও ট্রাম্পের দাবি, ইরান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে। যদিও ইরান বারবার জোর দিয়ে বলেছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত। জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাও (আইএইএ) ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা নিয়ে ইসরায়েলের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।ইসরায়েল অনেক দিন ধরেই বলছে, ইরান পরমাণু অস্ত্র অর্জনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে ইরানি কর্মকর্তারা এখনো বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি। হয়তো তাঁরা হামলার প্রভাব কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছেন। এ দাবির পক্ষে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের হামলার নিন্দা জানিয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, কূটনীতির সময় পেরিয়ে গেছে এবং তাঁর দেশের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এক সংবাদ সম্মেলনে আরাগচি আরও বলেন, ‘এই আগ্রাসনের যে বিপজ্জনক পরিণতি ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে, তার জন্য একমাত্র এবং সম্পূর্ণ দায় ওয়াশিংটনের যুদ্ধবাজ ও আইনের তোয়াক্কা না করা প্রশাসনের।’
যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে ইরানি কর্মকর্তারা এখনো বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি। হয়তো তাঁরা হামলার প্রভাব কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছেন।
টেলিভিশনে দেওয়া এক বক্তৃতায় ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থার উপরাজনৈতিক পরিচালক হাসান আবেদিনি বলেন, ‘আগেই তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা খালি করে ফেলা হয়েছিল। সেখানে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কারণ, উপকরণগুলো আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।’
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ক্ষেত্রে হামলা ইরানের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা দেখে নেওয়া যাক।
গতকাল ট্রাম্প বলেছেন, পূর্ণমাত্রার বোমা বহর দিয়ে ইরানের ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাতে জানা গেছে, ইরানি কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যে ওই তিনটি স্থাপনাই হামলার শিকার হয়েছে।
ফর্দো একটি ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা ২০০৬ সাল থেকে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। রাজধানী তেহরানের উত্তরের কোম শহর থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার (৩০ মাইল) দূরে পাহাড়ের গভীরে নির্মিত এই স্থাপনাটি প্রাকৃতিকভাবে আড়ালে অবস্থান করছে। গতকালের হামলার প্রধান লক্ষ্যস্থল ছিল এই ফর্দো পারমাণবিক ক্ষেত্র।
হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কাইন গতকাল এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ফর্দোতে বিস্তৃত ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন এমওপিএস বা বাংকারবিধ্বংসী বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। বোমাগুলো বি-টু স্টেলথ বোমারু বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
১৩ হাজার কেজি (২৮ হাজার ৭০০ পাউন্ড) ওজনের জিবিইউ-৫৭ হলো সবচেয়ে শক্তিশালী বাংকারবিধ্বংসী বোমা, যা মাটির নিচে ৬০ মিটার (২০০ ফুট) পর্যন্ত প্রবেশ করতে সক্ষম এবং সেগুলোতে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪০০ কেজি (৫ হাজার ৩০০ পাউন্ড) বিস্ফোরক উপাদান থাকে। পাশাপাশি, এই বোমারু বিমানগুলো রাডারে ধরা পড়া খুবই কঠিন।
কাইন আরও বলেন, কমপক্ষে দুটি পারমাণবিক স্থাপনায় মোট ১৪টি এমওপি বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে।
এর আগে ১৩ জুন ইসরায়েল ফর্দোতে হামলা চালিয়ে পারমাণবিক ক্ষেত্রটির ওপরের অংশের ক্ষতি করেছে। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শুধু মার্কিন বাংকারবিধ্বংসী বোমাগুলোই ওই স্থাপনাটির ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম।
নাতাঞ্জ পারমাণবিক ক্ষেত্র ইরানের সবচেয়ে বড় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এটি তেহরান থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার (১৮৬ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত। দুটি পারমাণবিক ক্ষেত্রের সমন্বয়ে এটি গঠিত বলে ধারণা করা হয়।
এর মধ্যে একটি হলো পাইলট ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট (পিএফইপি), যা মাটির ওপর অবস্থিত একটি পরীক্ষাগার ও গবেষণাকেন্দ্র। এখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য ব্যবহৃত দ্রুত ঘূর্ণমান সেন্ট্রিফিউজার যন্ত্রগুলো সংযোজন করা আছে।
অলাভজনক সংস্থা নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভের তথ্যানুযায়ী, ওই স্থাপনায় হাজারো সেন্ট্রিফিউজার রয়েছে।
মাটির গভীরে অবস্থিত অন্য স্থাপনাটি হলো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট (এফইপি)। নাতাঞ্জে হামলায় কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তা কাইন গতকাল নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।
ইসফাহান হলো একটি পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্র, যা মধ্য ইরানের ইসফাহান শহরে অবস্থিত। এটি ১৯৭০-এর দশকে নির্মিত হয়েছিল এবং ইউরেনিয়াম রূপান্তরের কাজে ব্যবহার করা হতো।
সূত্রমতে, শনিবার দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার সর্বশেষ লক্ষ্যবস্তু ছিল ইসফাহান পারমাণবিক ক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১২৫টি বিমান ইরানে এই হামলায় অংশ নিয়েছে।
কাইন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন থেকে ইসফাহান লক্ষ্য করে দুই ডজনের বেশি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযান শনাক্ত করতে পারেনি এবং পরে তাদের জানানো হয় বলেও জানান কাইন। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) থেকেও বলা হয়েছে, হামলার শিকার স্থাপনাগুলোর আশপাশে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বাড়েনি।
স্বাধীনভাবে মূল্যায়িত না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ফর্দোতে কী প্রভাব পড়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। গতকাল মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী, আমাদের সব অস্ত্র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ঠিকভাবে আঘাত হেনেছে এবং প্রত্যাশিত ফলাফল দিয়েছে।’ তিনি বিশেষ করে ফর্দোতে সুনির্দিষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ইরানের একজন আইনপ্রণেতা এ বিষয়ে আল–জাজিরাকে বলেছেন, হামলায় ফর্দোতে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেন, গত সপ্তাহে ইসরায়েলের হামলায় ওই ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় যদি কোনো ক্ষতি হয়েও থাকে, তা সীমিত মাত্রায় হয়েছে। গতকাল আইএইএ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইসফাহানে ছয়টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে একটি ভবনে ছিল দূষিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওয়ার্কশপ।
এর আগে সংস্থাটি থেকে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলের হামলায় ওই স্থাপনার চারটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারও রয়েছে।
এই আগ্রাসনের যে বিপজ্জনক পরিণতি ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে তার জন্য একমাত্র এবং সম্পূর্ণ দায় ওয়াশিংটনের যুদ্ধবাজ ও আইনের তোয়াক্কা না করা প্রশাসনের। ইরান ও পার্শ্ববর্তী উপসাগরীয় দেশ যেমন কুয়েত থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর কোনো স্থাপনা থেকেই উল্লেখযোগ্য মাত্রার তেজস্ক্রিয় উপাদান ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা এই ইঙ্গিত দেয় যে ইরানি কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের হামলা করা স্থাপনাগুলো থেকে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত আগেই সরিয়ে ফেলেছিলেন।
ইরানের সংবাদ সংস্থা আইআরএনএর খবরে বলা হয়েছে, ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার উপপরিচালক ও দেশের জাতীয় পারমাণবিক নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রধান রেজা কারদান গতকাল নিশ্চিত করে বলেছেন, স্থাপনাগুলোর বাইরে কোনো তেজস্ক্রিয় দূষণ বা পারমাণবিক বিকিরণ দেখা যায়নি।
কারদান আরও বলেন, ‘দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। আগেই এই প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আজ সকালে পারমাণবিক স্থাপনায় সন্ত্রাসী হামলা সত্ত্বেও এসব স্থাপনার বাইরে কোনো তেজস্ক্রিয় দূষণ বা পারমাণবিক বিকিরণ দেখা যায়নি।’ আইএইএ থেকেও বলা হয়েছে, হামলার শিকার স্থাপনাগুলোর আশপাশে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বাড়েনি।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে বলা হয়েছে, ফর্দোসহ ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর এখন পর্যন্ত কোনো স্থাপনার চারপাশে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বৃদ্ধির কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে আইএইএ নিশ্চিত করছে।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রিটা পার্সি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগেই ইরান সম্ভবত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছিল।
পার্সি আল–জাজিরাকে বলেন, দেখে মনে হচ্ছে, তারা আগেই একটি পূর্বসতর্কতা পেয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, ‘তিনি (ট্রাম্প) প্রকৃতপক্ষে হামলা চালাতে সামরিক সরঞ্জাম স্থানান্তর করতে সময় নিচ্ছেন। তাই আমার ধারণা, ইরান কিছুদিন আগেই সেসব সম্পদ সরিয়ে ফেলেছিল। তবে বর্তমানে সেগুলো কোথায় আছে, তা স্পষ্ট নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের সামগ্রিক পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর প্রভাব এখনো অজানা। তবে বিশ্লেষকদের মতে, ইরান আদতে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিতে অগ্রসর হচ্ছে, এমন কোনো স্পষ্ট প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
পার্সি বলেন, ইরানের সবচেয়ে মূল্যবান পারমাণবিক সম্পদ হলো এর সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত। যতক্ষণ তাদের কাছে সেগুলো রয়েছে, ততক্ষণ তাদের কাছে প্রকৃতপক্ষে একটি পরমাণু কর্মসূচি রয়েছে, যা অস্ত্রে রূপান্তরিত হতে পারে।
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে নিজেদের সফলতা বলে বর্ণনা করেছেন ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তাদের বোমারু বিমানগুলো সাফল্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে নিরাপদে ফিরে এসেছে।
খুব বেশি দিন তাদের মুখে এই সাফল্যের গল্প শোনা যাবে না বলেও মত ট্রিটা পার্সির। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, খুব শিগগিরই আমরা ইসরায়েলের পক্ষ থেকে শুনতে পাব, ট্রাম্প যে সফল হামলার দাবি করেছেন, তা আসলে সে রকম হয়নি। ইরানের বিরুদ্ধে আরও দীর্ঘমেয়াদি বোমাবর্ষণ অভিযান চালানোর প্রয়োজনীয়তার পক্ষে তারা নিজেদের যুক্তি তুলে ধরতে শুরু করবে।’
এ প্রশ্নের উত্তর, হ্যাঁ হয়েছিল। ইরানের পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে। যে সময়ে দেশটির শাসক ছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, যিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন।
শাহের মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা গড়ে তোলা—প্রধানত জ্বালানি উৎপাদনের জন্য এবং আংশিকভাবে যুদ্ধাস্ত্র তৈরির জন্য। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং ফ্রান্স—সবাই ইরানকে প্রযুক্তি সরবরাহ করে সহায়তা করেছিল।
তবে, ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানের নতুন সরকার পরমাণু কর্মসূচির কিছু অংশ স্থগিত বা বন্ধ করে দেয়। তাদের যুক্তি ছিল, এটি ব্যয়বহুল এবং এটি ইরানের পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতার প্রতিফলন।
ইরান এবং পার্শ্ববর্তী উপসাগরীয় দেশ যেমন কুয়েত থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর কোনো স্থাপনা থেকেই উল্লেখযোগ্য মাত্রার তেজস্ক্রিয় উপাদান ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেনি।
বাতিল বা স্থগিত রাখা কর্মসূচিগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইরান-ইরাক যুদ্ধের (১৯৮০-১৯৮৮) সময়। যখন ইরাকের আগ্রাসনে ইরান সরকারকে যুদ্ধ ব্যয় খাতে সম্পদের স্থানান্তর করতে বাধ্য হতে হয়েছিল।
শিল্পোৎপাদনের বৃহৎ কোম্পানি সিমেন্সের অংশীদারত্বে সে সময়ে বুশেহর পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর সাইটের নির্মাণকাজ চলছিল। ইরাকের বোমাবর্ষণে সাইটটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। সিমেন্স ওই নির্মাণ প্রকল্প প্রত্যাহার করে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে ইরান সরকার বুশেহর পারমাণবিক কর্মসূচি আবার চালু করে বলে খবর পাওয়া যায়। ইরান সরকার সব সময় জোর দিয়ে বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির লক্ষ্য শুধু বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরমাণু শক্তির ব্যবহার করা।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি কম্পিউটার ভাইরাস স্টাক্সনেট, যা সম্ভবত ২০০৫ সালে ছাড়া হয়েছিল। কিন্তু আবিষ্কৃত হয় ২০১০ সালে। একটি কৌশলগত কম্পিউটার ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার, যা বিশেষভাবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেন্ট্রিফিউজারগুলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নষ্ট করতে ডিজাইন করা হয়েছিল। এই ভাইরাস ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
ম্যালওয়্যারটি ‘অলিম্পিক গেমস’ নামে খ্যাত, এই কর্মসূচি ইরানের নেটওয়ার্কে ভীতি সৃষ্টি করে সেন্ট্রিফিউজারগুলোকে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করে ভেঙে ফেলতে বাধ্য করেছিল।
এটির সম্পর্কে পাওয়া প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে এটি দ্রুত ছড়ালেও এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আরেক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সময়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী, আমাদের সব অস্ত্র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ঠিকভাবে আঘাত করেছে এবং প্রত্যাশিত ফলাফল দিয়েছে।
২০১৫ সালের ইরান পরমাণু চুক্তির অধীনে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিনিময়ে তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতা সীমিত করে করেছিল। এই চুক্তিটি ইরান, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশে সীমিত রাখা হয়।
চুক্তির পর ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের সময় থেকে আরোপিত কিছু নিষেধাজ্ঞাসহ মোট নিষেধাজ্ঞাগুলো ধাপে ধাপে তুলে নেওয়া হয়। আইএইএর মতে, তেহরান চুক্তির শর্ত মেনে চলেছিল। দেশটির সরকার আইএইএকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারেও সম্মত হয়েছিল।
কিন্তু ট্রাম্প ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে সরিয়ে নেন এবং সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে ইরানের ওপর আবার কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ফলে তেহরানও চুক্তির শর্ত মানা বাদ দেয়, যদিও তারা আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছিল।
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ