ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

১০ আষাঢ় ১৪৩২, ২৭ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত হয় গত বছর, হত্যার তালিকাও

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১২:৩২, ২৪ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১২:৩৪, ২৪ জুন ২০২৫

ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত হয় গত বছর, হত্যার তালিকাও

ছবি: সংগৃহীত

ইরানে গত ১৩ জুন আকস্মিক হামলা চালায় ইসরায়েল, যা গোটা বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। তবে হামলার এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ নেওয়া হয়নি। দীর্ঘ প্রস্তুতি, পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই যুদ্ধপথে এগোচ্ছিল তেল আবিব। যুক্তরাষ্ট্র তখনো দ্বিধায় থাকলেও, ইসরায়েল তাদের নিজস্ব হিসেবেই এগিয়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন দেশটির বর্তমান ও সাবেক একাধিক কর্মকর্তা।

ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, এই হামলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের শরৎকাল থেকেই— যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি এবং কূটনৈতিক সমাধানের পথে ইরানের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়নি। সে সময় থেকেই ইসরায়েল ধাপে ধাপে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি নেয়। ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস, হিজবুল্লাহকে দুর্বল করে দেওয়া এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্ভাব্য হামলার নিশানা নির্ধারণ ছিল এই প্রস্তুতির অংশ।

ইসরায়েলি গোয়েন্দারা গোপনে বৈঠক করে ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানী ও সামরিক নেতাদের একটি তালিকা তৈরি করেন, যাদের ভবিষ্যতে হত্যা করা হতে পারে। এ ছাড়া লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বারবার টার্গেট করে ‘আকাশপথ পরিষ্কারের’ কৌশল গ্রহণ করা হয়— ভবিষ্যৎ হামলাকে নির্বিঘ্ন করতে।

ইসরায়েলের মতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ধ্বংস করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ জরুরি। কারণ, সম্মিলিত সামরিক অভিযান একক ইসরায়েলি অভিযানের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর হবে। এ কারণে ইসরায়েল একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে, বিশেষত তৎকালীন বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে।

তবে মার্কিন গোয়েন্দা বিশ্লেষকেরা তখনো মনে করছিলেন, ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব পারমাণবিক বোমা তৈরির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। এই মূল্যায়ন ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথমদিকেও একইরকম ছিল। ফলে ইসরায়েলের বারবার চেষ্টার পরও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তৎক্ষণাৎ সরাসরি সামরিক সহায়তার আশ্বাস মেলেনি।

ইসরায়েলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র অংশ নিক বা না-ই নিক, ২০২৫ সালের জুনের মধ্যেই ইরানে হামলা চালানো হবে— এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা গত বছরের মার্চ মাসেই। এটি ছিল নেতানিয়াহুর ৭ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই গৃহীত সিদ্ধান্ত।

তারা ধারণা করেছিল, বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ইরান তাদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের মাধ্যমে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সেই বিবেচনায় জুনের আগেই হামলা চালানো জরুরি হয়ে পড়ে।

যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নতুন কোনো গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নেওয়া হয়নি। বরং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার এটিকে একটি কৌশলগত ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হিসেবে দেখেছিল। ইসরায়েলের মতে, তারা ছিল সর্বোচ্চ প্রস্তুত, আর ইরান ও তার মিত্রদের শক্তি তখন সবচেয়ে দুর্বল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইসরায়েলি কর্মকর্তার ভাষায়, এই সময়টি ছিল একযোগে সুযোগ ও প্রয়োজন— এই দুইয়ের মিলনস্থল। এর চেয়ে ভালো সময় আর হতো না।

হামলার পর মার্কিন প্রশাসনের ভেতরেও তীব্র মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডের মূল্যায়নকে নাকচ করে দেন, যেখানে বলা হয়েছিল— ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির নির্দেশ দেয়নি।

তবে ট্রাম্পের দাবি ছিল ভিন্ন। তিনি বিশ্বাস করেন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে। একই বক্তব্য বহু বছর ধরেই দিয়ে আসছেন নেতানিয়াহু। তার বরাবরের অবস্থান হলো, ইরানকে সামরিক শক্তির মাধ্যমেই থামানো সম্ভব।

তবে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু স্বীকার করেছেন, ইরান সম্ভবত এখনো কয়েক মাস কিংবা এক বছর দূরে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পর্যায় থেকে।

বিশ্বজুড়ে এই হামলা নিয়ে এখন সবচেয়ে বড় বিতর্ক হলো— এটি আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে কতটা বৈধ? পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা আদৌ ছিল কিনা, তা নিয়েও নিশ্চিত কোনো প্রমাণ এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে— নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল কি একটি কল্পিত আশঙ্কার ভিত্তিতে যুদ্ধ শুরু করল?

যদিও একাধিক স্বাধীন গবেষণা বলছে, ইরান বিপুল পরিমাণে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে— যা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যের তুলনায় বহুগুণ বেশি। তারা একই সঙ্গে উন্নত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। তবে এসব তথ্য কতটা নির্ভরযোগ্য ও তাৎক্ষণিক হুমকি, তা নিয়ে বিশ্লেষকেরা দ্বিধান্বিত।

ইসরায়েলের সরকারপন্থী টেলিভিশন চ্যানেল ১৪-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু জানান, ইরানে হামলার নির্দিষ্ট তারিখ তিনি ঠিক করেন হামলার দুই সপ্তাহ আগে। তবে এই অভিযানের কঠিন সিদ্ধান্ত তিনি কয়েক মাস আগেই নিয়েছিলেন। এতে বোঝা যায়, পরিকল্পনা ছিল বহুদিন ধরেই; বাস্তবায়ন ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন