ঢাকা, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

১০ আষাঢ় ১৪৩২, ২৭ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

ইরানের কতটা গভীরে থাকে মোসাদ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ২০:১২, ২৪ জুন ২০২৫

ইরানের কতটা গভীরে থাকে মোসাদ

ইরানে সাম্প্রতিক সময়ে চালানো একাধিক হামলায় লক্ষ্যবস্তু ছিল দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি অনুযায়ী, এই অভিযান কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়; বরং বহু বছর ধরে গড়ে তোলা গোয়েন্দা পরিকল্পনার অংশ। মূল কুশীলব—ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।

নজিরবিহীন হামলা ও পরিকল্পনার বিস্তার

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোর একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়েছে। নিহত হয়েছেন একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা। মোসাদ দাবি করেছে, তারা ইতিমধ্যে ইরানের নিরাপত্তা কাঠামোর ভেতরে গভীর অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে।

গত কয়েক বছরে ইরানে মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি, তথ্য পাচার এবং জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালানোর অভিযোগে বহু লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ইরান সরকার উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ইন্টারনেট-সংযুক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে, যাতে ইসরায়েলি হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি কমে।

এআই ও মানব গোয়েন্দার সমন্বয়

সম্প্রতি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীর ১০ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে, কীভাবে মানব গোয়েন্দা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একসঙ্গে কাজে লাগিয়ে ইরানের সামরিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানা হয়েছে।

মোসাদের সাবেক গবেষণা পরিচালক সিমা শাইন বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে রুখে দিতে বহু বছর ধরে যে পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, এ হামলা তারই বাস্তব রূপ।’

মাঠ পর্যায়ের সহযোগী নেটওয়ার্ক

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজা আত্তার আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইরানে ইসরায়েলের ৩০ থেকে ৪০টি সক্রিয় সেল থাকতে পারে। এর বেশির ভাগই স্থানীয় সহযোগী। কেউ অস্ত্র পাচারে, কেউ হামলা, আবার কেউ কেবল তথ্য সংগ্রহে নিয়োজিত।’

একাধিক সূত্র জানায়, ইসরায়েলি এজেন্টরা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র গোপনে ইরানে প্রবেশ করিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালিয়েছে। এই লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়েছে একটি মার্কিন এআই মডেল, যা ইরানের ভেতরের গোয়েন্দা তথ্য ও অতীত আক্রমণের বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিয়েছে।

হামলা কি এখনো চলছে?

এ পর্যন্ত পাওয়া প্রমাণ বলছে—হ্যাঁ। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ইরানের কুদস বাহিনীর দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাঈদ ইজাদি ও বেনাম শাহরিয়ারি নিহত হয়েছেন। এর আগে ১৭ জুন নিহত হন মেজর জেনারেল আলি শাদমানি। ইসরায়েলি সূত্রের দাবি, এসব অভিযানের পেছনে সক্রিয় রয়েছে তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক।

পুরনো শত্রুতার ধারাবাহিকতা

ইসরায়েলের গোয়েন্দা অনুপ্রবেশ ইরানে নতুন নয়। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরানকে লক্ষ্য করে মোসাদ পরিচালিত হয়ে আসছে গোপন অভিযান। ২০১০ সালে স্টাক্সনেট ভাইরাস দিয়ে ইরানের ১৪টি পারমাণবিক স্থাপনায় সাইবার হামলা, পরমাণু বিজ্ঞানী মহসেন ফাখরিজাদে-কে হত্যা, এমনকি হানিয়া ও হিজবুল্লাহ নেতাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক হামলা—সবই এই ধারাবাহিকতার অংশ।

২০২৪ সালের নভেম্বরে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টা আলী লারিজানি স্বীকার করেন, ‘ইসরায়েলের অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি এখন জটিল আকার নিয়েছে। কিছু বিষয়ে আমাদের অবহেলা ছিল।’

ইরানও কি গোয়েন্দা অভিযান চালায়?

নিশ্চয়ই। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত জানায়, তারা সাতজন ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে, যারা ইরানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন। একই মাসে আরও সাতজনকে আটক করা হয়, যাঁরা যুদ্ধকালীন সহায়তার অভিযোগে অভিযুক্ত।

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব এখন শুধু যুদ্ধ বা কূটনীতির পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; এটা এক গভীর, বহুস্তরীয় গোয়েন্দা যুদ্ধ, যেখানে প্রযুক্তি, স্থানীয় সহযোগিতা এবং সাইবার কৌশল একে অপরের সঙ্গে মিশে তৈরি করছে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতির নতুন বাস্তবতা।

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ

আরও পড়ুন