শিরোনাম
ক্রীড়া ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯:২৮, ২৪ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৩:৩৮, ২৪ জুন ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
মাত্র ছয় বছর বয়সে দাদির হাত ধরে যে ছোট্ট ছেলেটি পাড়ার মাঠে বলের পেছনে ছুটেছিলেন, সেখান থেকেই শুরু হয় ‘দ্য পয়েন্ট অব ডিফারেন্স’-এর যাত্রা। উঁচু উঁচু খেলোয়াড়দের ফাঁক গলে নিপুণ ভঙ্গিমায় বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সেই ছেলেটি যেন শুরু থেকেই আলাদা কিছু ছিল। তার বাঁ পা, নিখুঁত ভারসাম্য আর ক্ষিপ্র গতির পেছনে লুকিয়ে ছিল এক অবিনাশী স্বপ্ন।
এই তো, চলতি সপ্তাহেই ইতিহাস গড়লেন লিওনেল মেসি। কনকাকাফ অঞ্চলের কোনো ক্লাব যা করতে পারেনি, সেটাই করে দেখালেন মেসির ইন্টার মায়ামি। প্রথমবারের মতো কোনো ইউরোপীয় ক্লাবকে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে হারাল উত্তর আমেরিকার কোনো ক্লাব। মেসির বাঁ পা– যা তার সব সাফল্যের নেপথ্যে এক অলৌকিক অস্ত্র– সেই ম্যাচেও রঙ ছড়িয়েছে।
১৯৮৭ সালের ২৪ জুন, আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া লিওনেল আন্দ্রেস কুচিত্তেনি মেসি যেন ফুটবলের জন্যই পৃথিবীতে এসেছিলেন। দুর্দান্ত প্রতিভা, ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, অসাধারণ দুটি পা— এসব উপহার হিসেবে মিললেও জুটেছিল হরমোনজনিত জটিলতা। যে জটিলতা পার করলে জীবনটা হতে পারত একেবারেই অন্যরকম।
তবে মেসির গল্পটা তাই তো এত অনুপ্রেরণাদায়ক। রোজারিও থেকে বার্সেলোনা— সেই ন্যাপকিনে লেখা প্রথম চুক্তিপত্র, বার্সেলোনায় গড়া একের পর এক জাদুকরী রাত, সবকিছু যেন কোনো পরাবাস্তব কাহিনী। তবু বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়, বারবার দেখতেও। কারণ, এক সাধারণ ছেলেকে অসাধারণ হয়ে উঠতে দেখা মানেই আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত অনুরণন।
তাকে ঘিরে যেসব অপবাদ উঠেছে, একে একে সব ভেঙে দিয়েছেন তিনি। হেডে গোল করতে পারেন না— এই অপবাদকে ছাপিয়ে ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে হেডে করা সেই গোলটিকে নিজেই বলেছেন নিজের সেরা গোল। ইংলিশ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে ব্যর্থ— এই অপবাদ পেছনে ফেলে আজ তিনি ইংল্যান্ডের শীর্ষ ছয় ক্লাবের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি গোলদাতাদের একজন।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, মেসি কি শুধুই বার্সেলোনার? দেশের জার্সিতে কি কখনো আলো ছড়াতে পারবেন? এখন এই প্রশ্নগুলো হাস্যকরই ঠেকে। কারণ ২০২১ সালের কোপা আমেরিকা জয়ের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে তার জাতীয় দলের সঙ্গে বর্ণাঢ্য অধ্যায়। সেই ঐতিহাসিক রাতে মারাকানায়, ব্রাজিলের মাটিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে আর্জেন্টিনাকে উপহার দেন বহুপ্রতীক্ষিত ট্রফি। এরপর আসে ফিনালিসিমা, তারপর কাতারের সেই মহাকাব্যিক বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। প্রবল চাপের মুখে দ্বিতীয় ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে দূর থেকে নেওয়া এক শটে আবার জ্বলে ওঠেন মেসি। দলকে টেনে তোলেন, আগলে রাখেন, অনুপ্রাণিত করেন— সবশেষে লুসাইল স্টেডিয়ামে রচিত হয় অমর এক রূপকথা। মেসি শুধু বিশ্বকাপ জেতেননি, প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে সর্বকালের সেরা হিসেবে।
এই গল্পগুলো মানুষের মনে দাগ কাটে কারণ জীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তে সবাই চায় ‘পার্থক্য গড়ে দিতে’, বিজয়ী হয়ে ফিরতে। মেসি হয়ে উঠেছেন সেই চেনা অনুভবের রূপক। একদিকে হরমোনজনিত সমস্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অন্যদিকে ফুটবল বিশ্বের ভয়ঙ্কর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও নিজেকে অমর করে তোলা— মেসি যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা, যিনি জানেন কীভাবে সব বাধা পেরিয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়।
এখন মেসির বয়স ৩৮। জীবনের সবকিছুই প্রায় অর্জিত— তবু তিনি খেলে চলেছেন। তার লক্ষ্য এখন ২০২৬ বিশ্বকাপ। সব পেয়েও নতুন করে আরেকবার নিজের দেশকে কিছু দেওয়ার তাগিদ তার হৃদয়ে এখনো জ্বলন্ত। নিজের শেষটা করতে চান ঠিক সেই জায়গা থেকে, যেখানে হয়েছেন অমর।
রোজারিও থেকে যে ছেলেটা এসেছিল শুধু ভালোবাসা আর স্বপ্ন নিয়ে, তার গল্পটাও এবার আমাদের গল্প হয়ে গেছে। মেসির বিদায়ের সময়টায় আমাদের শৈশব, আবেগ আর ভালোবাসার একটা অধ্যায়ও হয়তো শেষ হয়ে যাবে— তবু থেকে যাবে এক অনুপ্রেরণার নাম: লিওনেল মেসি। পার্থক্য গড়ে দেওয়া সেই চিরন্তন মানুষ।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ