ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

১০ আষাঢ় ১৪৩২, ২৭ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

মেসির শরীরে আঁকা ট্যাটুগুলোর ভাষা আছে

ক্রীড়া ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩:৩৭, ২৪ জুন ২০২৫

মেসির শরীরে আঁকা ট্যাটুগুলোর ভাষা আছে

ছবি: সংগৃহীত

ফুটবল বিশ্বে একবিংশ শতকের একটি বড় সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে শরীরজুড়ে ট্যাটু করানো। ফুটবলারদের মধ্যে এই সংস্কৃতি এতটাই জনপ্রিয় যে, এখন অনেকের শরীরই যেন একটি জীবন্ত ক্যানভাস। ব্যতিক্রমও আছে অবশ্য। যেমন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। পরিপাটি জীবনাচারে অভ্যস্ত এই পর্তুগিজ তারকার শরীরে কোনো ট্যাটু নেই। কিন্তু তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসির শরীর ঠিক উল্টো উদাহরণ। তার শরীরে একাধিক ট্যাটু, যার প্রতিটি বহন করে একেকটি গল্প, একেকটি অর্থপূর্ণ স্মৃতি।

আজ লিওনেল মেসির ৩৮তম জন্মদিন। এই বিশেষ দিনে মেসির শরীরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ট্যাটুগুলোর আড়ালে থাকা অর্থ ও আবেগগুলো নিয়ে আলোচনা হোক। 

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে মেসির শরীরে মোট ১৮টি ট্যাটু রয়েছে। তবে এই সংখ্যাটি একেবারে নির্ভুল নয় বলেই ধরে নেওয়া যায়। কারণ মেসি সময়ের সঙ্গে ট্যাটু ঢেকে দেন, আবার নতুন ট্যাটুও করান। কিন্তু প্রতিটি ট্যাটুই অর্থবোধক। মেসির শরীরে একটি ট্যাটুও এমন নেই, যা নিছক অলঙ্কার হিসেবে করানো হয়েছে। প্রতিটি ট্যাটুর পেছনে রয়েছে একটি গভীর বার্তা কিংবা অনুভূতি।

মেসির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি অধিকার করে আছে তার পরিবার। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রথম ট্যাটুটি উৎসর্গিত তার মা সেলিয়া কুচিত্তিনিকে। ২০১১ সালে নিজের বাঁ কাঁধের পেছনে মায়ের মুখের প্রতিকৃতি আঁকিয়ে ট্যাটু করান মেসি। আজ যিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের একজন, তার বেড়ে ওঠার পেছনে মায়ের অবদানের স্বীকৃতিই ছিল এই ট্যাটু।

পরের বছর ২০১২ সালে প্রথম সন্তানের বাবা হন মেসি। সেই অনুভূতিও তিনি চিরস্থায়ী করে নেন নিজের শরীরে। বাঁ পায়ের পেছনে সন্তানের দুটি হাতের ট্যাটু করান তিনি। পরবর্তীতে সেই দুই হাতের মাঝখানে হৃদয়ের চিহ্ন যোগ করে লেখেন সন্তানের নাম— থিয়াগো। এই ট্যাটুর কারণেই অনেকে প্রথমে ভেবেছিলেন, এটি ম্যারাডোনার বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের স্মারক। তবে সন্তানকে সম্মান জানাতে এ ট্যাটু করেছেন মেসি।

২০১৫ সালে দ্বিতীয় সন্তান মাতেওর জন্মের পর তার নামটিও শরীরে ট্যাটু করান মেসি। সেটি রয়েছে মেসির বাঁ হাতে। তৃতীয় সন্তান সিরো জন্ম নেওয়ার পর তার নাম ও জন্মস্থানও জায়গা করে নেয় মেসির ডান পায়ের গোড়ালির ঠিক উপরের অংশে।

মেসির ট্যাটুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেগ ছড়ায় যেগুলো তার স্ত্রী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোকে ঘিরে। দুজনের প্রেমের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সেই সম্পর্কের প্রতি সম্মান জানিয়ে মেসি নিজের ডান বাহুর বাইসেপসে করিয়েছেন রোকুজ্জোর চোখের ট্যাটু। শুধু চোখই নয়, চুমু খাওয়ার ভঙ্গিতে রোকুজ্জোর ঠোঁটের ট্যাটুও রয়েছে তার শরীরে। রয়েছে যুগল ট্যাটুও— রোকুজ্জোর শরীরে রানির মুকুট আর মেসির শরীরে রাজার মুকুট।

মেসির ডান হাতে রয়েছে পদ্মফুলের একটি ট্যাটু। পদ্মফুলের প্রতীকী মানে হলো— প্রতিকূলতার মধ্যে পুনর্জন্ম ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা। এটি যেন মেসির জীবনের গল্পই: রোজারিওর এক সাদামাটা পরিবার থেকে উঠে এসে তিনি বিশ্বজয় করেছেন, হয়ে উঠেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার।

ধর্মীয় বিশ্বাস মেসির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। তার ডান হাতে আঁকা আছে যিশু খ্রিস্টের প্রতিকৃতি। খ্রিস্টান ধর্মালম্বী এই ফুটবলার বার্সেলোনার বিখ্যাত সাগরাদা ফ্যামিলিয়া ক্যাথেড্রাল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও একটি বিশেষ ট্যাটু করিয়েছেন— ‘রোজ উইন্ডো’। এই গোলাপি জানালার চারপাশে তিনি আঁকিয়েছেন কিছু ফুল, যার মধ্যে আছে লাল গোলাপ, গোলাপি পদ্ম ও কমলার ফুল। এটি ক্যাথলিক বিশ্বাস অনুযায়ী প্রার্থনা, আধ্যাত্মিকতা ও নান্দনিকতার প্রতীক।

তার ডান হাতের কনুইয়ের কাছে রয়েছে একটি বড় ঘড়ির ট্যাটু এবং ঘড়ির যন্ত্রাংশের ছবি। এর মাধ্যমে সময়ের মূল্য বোঝানোর চেষ্টা করেছেন মেসি।

ফুটবলপ্রেমীদের কাছে মেসির শরীরের সবচেয়ে পবিত্র অংশটি নিঃসন্দেহে তার বাঁ পা। সেই বাঁ পা, যা দিয়ে তিনি গড়েছেন একের পর এক রেকর্ড, ছুঁয়েছেন সাফল্যের শিখর। একসময় এই পায়ে ছিল তলোয়ার, দেবদূতের ডানা ও একটি লাল গোলাপের ট্যাটু। পরবর্তীতে তিনি গাঢ় কালো কালি দিয়ে তা ঢেকে দেন। তবু রেখে দেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন— যেমন তার প্রথম সন্তানের নাম থিয়াগো, পাশে লেখা ‘১০’ নম্বর, যা তার জাতীয় দল ও ক্লাবের জার্সি নম্বরের প্রতীক।

এই পায়ে আরো রয়েছে বার্সেলোনার লোগো এবং তাস খেলার ‘ফাইভ অব কাপস’ ট্যাটু। বিশেষ করে এই ‘ফাইভ অব কাপস’– এর একটি গভীর ব্যাখ্যা আছে, যা শুধু সৌন্দর্যের নয়, বরং সফলতারও প্রতীক।

২০২২ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর সবাই ভেবেছিলেন, হয়তো মেসি এবার বিশ্বকাপ ট্রফির ট্যাটু করবেন। কিন্তু মেসির শরীরে এমন কোনো সরাসরি ট্রফির চিহ্ন নেই। তবে তাঁর বাঁ পায়ের সামনের অংশে ‘ফাইভ অব কাপস’ ট্যাটু যুক্ত করা হয় বিশ্বকাপ জয়ের পর।

এই ট্যাটুতে ‘পাঁচ’ সংখ্যাটি বহন করে বহু অর্থ। এটি মেসির ক্যারিয়ারের শুরুর সময়ের স্কোয়াড নম্বর। পাশাপাশি তাঁর জীবনের পাঁচজন ঘনিষ্ঠ মানুষ— রোকুজ্জো ও তিন সন্তান এবং মা— তাদের প্রতিনিধিত্ব করে এটি।

এ ছাড়া, এই প্রতীকটি মেসির এক স্মরণীয় মুহূর্তও মনে করিয়ে দেয়। ‘সিন ইতার্নোস: ক্যাম্পেওনেস দে আমেরিকা’ তথ্যচিত্রে দেখা যায়, মেসি ও চার সতীর্থ তাস খেলছিলেন, এবং বারবার মেসিকে ‘ফাইভ অব কাপস’ নামে ডাকছিলেন। এটি যেন এক প্রকার ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে গিয়েছিল— বিশ্বকাপ জয় আসন্ন।

শেষ পর্যন্ত মেসি নিজেই যেন বলেছেন, তার এই ট্যাটুগুলো কেবলই দেহে আঁকা ছবি নয়। এগুলো তার জীবনের স্মারক, বিশ্বাস, ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, আবেগ আর অর্জনের চিহ্ন। শরীরের মতোই এই ট্যাটুগুলোও তার জীবনের অনিবার্য অংশ।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন