যখন ভালোবাসা হয়ে ওঠে অশান্তির কারণ, তখন তার ফলাফল হতে পারে মর্মান্তিক। এমনই একটি হৃদয়বিদারক কাহিনি হচ্ছে ২১ বছর বয়সী ইয়াসমিন আক্তার মাহী নামের এক তরুণীর জীবনের শেষ অধ্যায়ের গল্প। যশোরের ধর্মতলা এলাকার এক ভাড়া ফ্ল্যাটে ২২ জুলাই গভীর রাতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন এই আলোচিত টিকটকার মাহী। মৃত্যুর আগে তার হাতে লেখা বার্তাটি ছিল—‘ভালোবাসা বলতে কিছুই হয় না।’
শার্শা উপজেলার বেনাপোলের সাদিপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া মাহী, তার বাবা রবিউল ইসলাম পেশায় দিনমজুর এবং মা ফুলি বেগম গৃহিণী। মাহী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি ও জনপ্রিয়তার জন্য পরিচিত ছিলেন। ফেসবুক ও টিকটকে তার সৌন্দর্য, আত্মবিশ্বাস এবং সৃজনশীল কনটেন্টের মাধ্যমে দ্রুত হাজার হাজার অনুসারী হয়েছিল।
মাহীর জীবনে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক, শার্শার পুটখালী এলাকার বিতর্কিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী ‘গোল্ড নাসির’ নামে পরিচিত এক ব্যক্তির ভাতিজা সাকিবুল হাসান বিশালের সঙ্গে; যিনি একটি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান এবং স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও বিত্তশালী পরিবারের সদস্য।
প্রায় দেড় বছর আগে এই সম্পর্ক শুরু হয় এবং বিশাল যশোর শহরের ধর্মতলা এলাকায় একটি ভাড়া ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দেন মাহীর জন্য। ভাড়া, থাকা-খাওয়ার যাবতীয় খরচ বহন করতেন বিশাল। মাঝে মাঝে একসাথে থাকতেন তারা।
তবে এই সম্পর্ক গোপন রাখা সম্ভব হয়নি। বিশালের পরিবার বিষয়টি জানতে পেরে মাহীর ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করে। তাকে বিশালের জীবন থেকে দূরে থাকতে বলা হয় এবং মোবাইল ফোনে হুমকিও দেওয়া হয়। প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে মাহীর বড় ভাই মারধরের শিকার হন।
মাহীর ওপর নির্যাতনের অবসান ঘটেনি। ১৫ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত তারা একসঙ্গে ছিলেন ফ্ল্যাটে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়। ২০ জুলাই বিশালের পরিবার কোতোয়ালি থানায় মাহীর নামে একটি অভিযোগ দায়ের করে, যা মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে।
মর্যাদা ও সামাজিক বন্ধনের টানাপোড়েনের মুখে ভেঙে পড়েন মাহী। ২২ জুলাই গভীর রাতে নিজের গলায় ওড়না পেঁচিয়ে জীবনসংঘাত করেন। মৃত্যুর আগে নিজের মোবাইলে টিকটকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন, যেখানে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত ওড়নার ছবি এবং ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘ভালোবাসা বলতে কিছুই হয় না, ব্যর্থ...’
মৃত্যুর সময় মাহী প্রেমিক বিশালের সঙ্গে ভিডিও কলে ছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে নিজের কষ্ট, অপমান ও হতাশার কথা জানান তিনি। তবে বিশাল কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। মৃত্যুর পর বিশাল ফ্ল্যাটের মালিককে ফোন করে মাহীর বন্ধু-বান্ধবীকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
মাহীর পরিবার অভিযোগ করে বলেন, এই আত্মহত্যা একক ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত মানসিক নির্যাতনের ফল। প্রেমিক বিশাল ও তার পরিবারের হুমকি, সামাজিক অপমান ও কুৎসার কারণে মাহী এই পথ বেছে নিয়েছিলেন।
মাহীর বড় ভাই বলেন, ‘আমরা গরিব পরিবারের মানুষ, আমার বোন কখনো কারো ওপর নির্ভর করতে চাননি। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। ওই ছেলের ফাঁদে পড়ে তার জীবন শেষ হয়ে গেল। আমরা ন্যায়বিচারের দাবি জানাই।’
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসনাত জানান, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ মৃত্যুর প্ররোচনার অভিযোগে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
মাহীর এই মর্মান্তিক ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অনেকেই এটিকে শ্রেণিভিত্তিক সামাজিক নিপীড়নের উদাহরণ হিসেবে দেখছেন, যেখানে একজন সাধারণ নারীর জীবন বিনষ্ট হয় ক্ষমতাশালী পরিবারের চাপের কারণে। তার শেষ ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে বলছেন, এটি আত্মহত্যা নয়, বরং একটি পরিকল্পিত হত্যার রূপান্তর। ‘এই মৃত্যুর জন্য কে দায়ী?’—এই প্রশ্ন এখন সর্বত্র মুখরিত।
মাহী শুধু একজন ধনী পরিবারের ছেলেকে ভালোবেসেছিলেন, নাকি অপরাধ ছিল দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হওয়া এবং সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাওয়া?—এমন প্রশ্নও উঠেছে। একক মানসিক দুর্বলতার ফল নয়, এই আত্মহত্যাকে একটি সামাজিক অসাম্য ও শ্রেণিচাপের প্রতিফলন মনে করছেন অনেকেই।
বিশাল-মাহীর সম্পর্ক সমাজে ‘অসম সম্পর্ক’ হিসেবে চিহ্নিত। ধনী পরিবারের চোখে এটি ‘লজ্জাজনক’। সমাজিক মর্যাদা রক্ষার নামে মাহীর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। প্রেমে বাধা এলে নারীকেই দোষী মনে করা, ভয়-ভীতি, মামলা দিয়ে পরিবারকেও লাঞ্ছিত করা—এমন প্রবণতা সমাজে দিনের আলোয় চলছে।
টিকটক ও ফেসবুকে মাহীর প্রকাশ্য উপস্থিতির কারণে তিনি অনলাইনে অনেকবার অপমানিত হয়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জারে প্রাপ্ত হুমকিগুলোকে সুপরিকল্পিত মানসিক নির্যাতনের অংশ হিসেবে দেখছে পরিবারের লোকজন। অভিযোগ সত্ত্বেও পূর্বে পুলিশ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং বিশালের পরিবার ছিল শক্ত অবস্থানে।
প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করা, সামাজিক অপমান ও চাপ একজন তরুণীর মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে—এটি পরিবার, সমাজ ও কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে উপলব্ধি করা হয়নি।
প্রশ্ন থেকেই যায়, এই আত্মহত্যা কি প্রতিরোধযোগ্য ছিল না? একজন তরুণী ভিডিও কলের মাধ্যমে নিজের হতাশা জানালে প্রেমিক বা সংশ্লিষ্টদের কি দায়িত্ব ছিল না তাকে থামানোর?
মাহীর মৃত্যু স্পষ্ট করেছে যে, আমাদের সমাজে নারীর ভালোবাসার স্বাধীনতা, শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য ও ডিজিটাল সহিংসতা কত গভীর। এলাকাজুড়ে ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই বলছেন, এটা ‘আত্মহত্যা’ নয়, বরং ‘সোশ্যাল ক্লাস-ক্রাই’ এবং ‘মনস্তাত্ত্বিক খুন’।
যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠছে সর্বত্র। অনেকেই আশা করছেন, আইনি তদন্ত সুষ্ঠু হলে প্রকৃত সত্য সামনে আসবে।
মাহী এখন নেই, কিন্তু তার মৃত্যু সমাজের অসঙ্গতির এক দাগ রেখে গেল। সে রেখে গেলো অনেক বড় প্রশ্ন—একজন নারীর ভালোবাসার মূল্যায়ন, সমাজের দায়বদ্ধতা, সহানুভূতি এবং দেশের আইন-আদালতের কার্যকারিতা নিয়ে।
বিশালের পিতা অলিয়ার রহমান বলেন, ‘আমার ছেলে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। সে মাহীর সঙ্গে পরিচিত ছিল, কিন্তু মাহী তার থেকে অনেক বড়। আমার ছেলে এখন ক্লাস নয়মে পড়ে।’ তিনি বলেন, বিশালের সঙ্গে মাহীর সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন এবং পরে কথা বলবেন বলে মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেন।
অভিযুক্ত সাকিবুল হাসান বিশালের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা গেলেও ফোনটি বন্ধ ছিল। বারবার চেষ্টা করেও তাকে যোগাযোগ করা যায়নি।
যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই অনুপ কুমার সাহা জানান, এ সংক্রান্ত একটি অপমৃত্যু মামলা নং ৯৭ (২২/৭/২৫ তারিখ) দায়ের রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় তদন্ত চলছে।