ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৭:৪২, ১৩ জুন ২০২৫
জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি । ছবি: সংগৃহীত
এই হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার মৃত্যু হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, যিনি ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ এবং দেশের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন।
মোহাম্মদ বাঘেরির জন্ম নাম ছিল মোহাম্মদ হোসেইন আফশোরদি। ১৯৬০-এর দশকে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন এমন একজন সামরিক নেতা যিনি একইসঙ্গে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) এবং ইরানের অন্যান্য সেনাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতেন।
তাঁর ক্যারিয়ার ছিল আইআরজিসি'র মধ্যে এক বিশিষ্ট ইতিহাসে পরিপূর্ণ। যদিও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তিনি একাডেমিক দিক থেকেও প্রশংসিত ছিলেন এবং পশ্চিমা বিশ্বে একাধিকবার নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ছিলেন।
“ইরানের শীর্ষ গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তারা সাধারণত গোপনীয়তাপূর্ণ জীবনযাপন করেন,” বলেছেন রেজা এইচ আকবরি, ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার অ্যান্ড পিস রিপোর্টিং–এর মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক প্রোগ্রাম ম্যানেজার।
বাঘেরি ১৯৮০ সালে আইআরজিসিতে যোগ দেন। এটি ছিল ইরানি বিপ্লবের এক বছর পর এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হবার সময়। এই যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যার মধ্যে ইরান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই যুদ্ধে তাঁর বড় ভাই হাসান বাঘেরিও নিহত হন, যিনি আইআরজিসি'র সামরিক গোয়েন্দা শাখা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং মাত্র ২৭ বছর বয়সে একটি ডিভিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
এক মার্কিন কংগ্রেসনাল রিপোর্ট অনুসারে, বাঘেরি ছিলেন আইআরজিসি-এর প্রাথমিক নিয়োগপ্রাপ্তদের একজন, যিনি কুর্দি বিদ্রোহ দমন এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯৮৩ সালে ভাইয়ের মৃত্যুর পর বাঘেরি আইআরজিসি -এর গোয়েন্দা শাখার প্রধান হন। পরবর্তীতে তিনি সেনাবাহিনীর কমন অ্যাফেয়ার্সের প্রধান, গোয়েন্দা ও অপারেশন বিভাগের উপপ্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৭ সালে তিনি ইরাকের কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি বিশেষ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয়-সম্পৃক্ত সংবাদমাধ্যম ‘রোকনা’।
২০১৬ সালে তিনি মেজর জেনারেল সাইয়্যেদ হাসান ফিরুজাবাদির স্থলাভিষিক্ত হন, এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব নেন।
রেজা আকবরি বলেন, বাঘেরি ছিলেন আইআরজিসি -এর একটি অভিজাত ইউনিটের সদস্য, যাদের মূল দায়িত্ব ছিল সবচেয়ে স্পর্শকাতর মিশন—বিশেষ করে বিমান বাহিনী সংশ্লিষ্ট কাজকর্ম।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্প প্রশাসনের সময় তাঁকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনে, যেখানে বলা হয় তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির ঘনিষ্ঠতমদের একজন ছিলেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাঁকে নিষিদ্ধ করে। অভিযোগ— রাশিয়াকে ড্রোন সরবরাহে ভূমিকা থাকার জন্য। এছাড়া ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ দমনেও তাঁর নাম উঠে আসে, যার কারণে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যও নিষেধাজ্ঞা দেয়।
বাঘেরির মৃত্যুর পর, ইরান সাবেক প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ বাহিদিকে তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ দেয়।
শুধু বাঘেরিই নন, এই একই হামলায় ইসরায়েল আইআরজিসি -এর প্রধান হোসেইন সালামি এবং সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান ঘোলাম আলী রাশিদ–কেও হত্যা করে।
এছাড়াও নিহত হন বহু পারমাণবিক বিজ্ঞানী।
এই হামলা এমন এক সময়ে ঘটে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আগামী রবিবার ওমানের মাসকাটে পরবর্তী পরমাণু আলোচনা করতে যাচ্ছিল। গত ক’দিন ধরেই মার্কিন ও ইসরায়েলি আক্রমণের আশঙ্কা নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছিল। মার্কিন দূতাবাসগুলোতে জারি করা হয়েছিল নিরাপত্তা সতর্কতা, আর ইরানও হুমকি দিয়েছিল পাল্টা প্রতিক্রিয়ার।
এ হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে আখ্যা দিয়েছে সৌদি আরব, ওমান, কাতারসহ বহু উপসাগরীয় রাষ্ট্র।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ জানিয়েছেন যে, আলোচনা রবিবার যথারীতি চলবে বলে আশা করছেন।
তবে বিশ্লেষক রেজা আকবরি বলেন, “আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এখন একেবারে ক্ষীণ।”
জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি ছিলেন এমন একজন সেনা কর্মকর্তা, যিনি ইরানের সামরিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। তাঁর মৃত্যু শুধু ইরানের জন্য নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে বড় একটি ধাক্কা। তার নেতৃত্বের অভাব এখন তেহরানের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিশোধ কৌশল কেমন হবে, সেটাই নির্ধারণ করবে।
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এসএ