ঢাকা, রোববার, ১৫ জুন ২০২৫

৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

যেভাবে ইরানের শত্রুতে পরিণত হয় ইসরায়েল

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮:০১, ১৩ জুন ২০২৫

যেভাবে ইরানের শত্রুতে পরিণত হয় ইসরায়েল

আজ শুক্রবার (১৩ জুন) ভোররাতে ইরানে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। তেহরানে চালানো এ হামলা এমন এক সময় হলো, যখন পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ওমানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে এটিই সবচেয়ে সরাসরি ও বড় ধরনের হামলা বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে ‘ছায়াযুদ্ধ’ দীর্ঘদিন ধরেই চলে এলেও আজকের এই হামলা সেই সংঘাতকে আরও একধাপ ওপরে নিয়ে গেছে—এবার আর শুধু পরোক্ষ নয়, সরাসরি।

দীর্ঘ চার দশকের বৈরিতা: কিছু গুরুত্বপূর্ণ মোড়

১৯৭৯ | ইসলামি বিপ্লব ও ইসরায়েলবিরোধিতার শুরু

ইরানের পশ্চিমাপন্থী নেতা মোহাম্মদ রেজা শাহ ইসরায়েলকে মিত্র দেশ হিসেবে বিবেচনা করতেন। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের ফলে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এই বিপ্লবের ফলে ইরানে শিয়াপন্থী ধর্মতন্ত্রভিত্তিক একটি নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাসনব্যবস্থার আদর্শগত নীতির অন্যতম ভিত্তি ছিল ইসরায়েলবিরোধিতা।

১৯৮২ | হিজবুল্লাহর জন্ম

এ বছর ইসরায়েল লেবাননে আক্রমণ চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির শিয়া মুসলিম নেতারা সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ গড়ে তোলে। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। পরবর্তী সময়ে এই আধাসামরিক সংগঠনটি সীমান্তে ইসরায়েলের সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়।

১৯৮৩ | আত্মঘাতী হামলা লেবাননে

লেবানন থেকে পশ্চিমা ও ইসরায়েলি বাহিনীকে বিতাড়িত করতে ইরান–সমর্থিত হিজবুল্লাহ আত্মঘাতী বোমা হামলার কৌশল গ্রহণ করে। এ বছরের নভেম্বর মাসে বিস্ফোরক ভর্তি একটি গাড়ি লেবাননে ইসরায়েলের সামরিক সদর দপ্তরে ঢুকে হামলা চালায়। এরপর ইসরায়েল লেবাননের বেশির ভাগ এলাকা থেকে সরে আসে।

১৯৯২–৯৪ | আর্জেন্টিনায় দূতাবাস ও জুইশ সেন্টারে হামলা

আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে ১৯৯২ সালে ইসরায়েলি দূতাবাস এবং একটি জুইশ সেন্টারে আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বহু মানুষ নিহত হন। আর্জেন্টিনা ও ইসরায়েল এ হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে ইরান ও হিজবুল্লাহকে দায়ী করে। তবে ইরান ও হিজবুল্লাহ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

২০০২ | ইরানের গোপন পরমাণু কর্মসূচি ফাঁস

ইরানের গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি ফাঁস হওয়ার ফলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয় যে, তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারে। আর এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে তা হবে দেশটির আন্তর্জাতিক চুক্তির পরিপন্থী। যদিও ইরান এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। অন্যদিকে এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল তেহরানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।

২০১০ | স্টাক্সনেট সাইবার হামলা

ওই বছর লেবাননে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ মাসব্যাপী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ইসরায়েল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হিজবুল্লাহকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে কার্যকরী একটি সমঝোতার মধ্য দিয়ে ওই যুদ্ধের অবসান ঘটে।

২০১২ | ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যা

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এক বক্তৃতায় ইসরায়েলকে ‘একটি বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী ক্যানসার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

২০১৮ | সিরিয়ায় ইরানি ঘাঁটিতে ইসরায়েলি হামলা

ইরান-সমর্থিত বাহিনীর গোলান মালভূমিতে রকেট ছোড়ার জবাবে সিরিয়ায় ইসরায়েল বিমান হামলা চালায়।

২০২০ | কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ড

মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন কুদস ফোর্স প্রধান। ইসরায়েল এই হত্যাকে স্বাগত জানায়। ইরান পাল্টা হামলা চালায় মার্কিন ঘাঁটিতে।

২০২১ | মোহসেন ফখরিজাদেহ হত্যাকাণ্ড

ইরানের ‘পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্পের স্থপতি’ হিসেবে পরিচিত এই বিজ্ঞানীর হত্যার পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে বলে দাবি তেহরানের।

২০২২ | যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েল চুক্তি

‘জেরুজালেম ঘোষণা’র মাধ্যমে ইরানকে প্রতিহত করতে যৌথ প্রতিশ্রুতি দেয় দুই দেশ।

২০২৪ এপ্রিল | দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা

ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন আইআরজিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা। ইরান তার জবাবে ১৩ এপ্রিল সরাসরি ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।

২০২৪ অক্টোবর | নেতাদের হত্যাকাণ্ড ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া

হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যার জবাবে ইরান ১৮০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালায়।

২০২৫ সালের নতুন মোড়: ‘রাইজিং লায়ন’ অভিযান

১৩ জুন ভোররাতে ইসরায়েল ‘রাইজিং লায়ন’ নামে একটি অভিযানের মাধ্যমে ইরানে ব্যাপক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। লক্ষ্যবস্তু ছিল

-তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনা

-বিজ্ঞানী ও সামরিক কমান্ডার

-ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুতকারক কারখানা

এই হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, আইআরজিসি প্রধান হোসেইন সালামি এবং পরমাণু বিজ্ঞানী ফারেদুন আব্বাসি ও মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি নিহত হয়েছেন বলে দাবি তেহরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের।

যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, এ অভিযানে তারা কোনো সহায়তা করেনি। তবে আগের দিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, “মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক।” এরপরই মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

ইরান–ইসরায়েল সম্পর্ক আর আগের মতো ‘ছায়াযুদ্ধের’ স্তরে নেই। হামলা–পাল্টা হামলা এখন প্রকাশ্য রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই উত্তেজনা কেবল দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্ব রাজনীতির স্থিতিশীলতার জন্য এটি একটি অশনিসংকেত।

এমআরএইচ

আরও পড়ুন