শিরোনাম
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১০:৪০, ২২ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১২:০০, ২২ জুন ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সূত্র ও সামরিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এই সংঘাতের সূচনা আসলে হয়েছিল আকাশপথ দিয়ে নয়, বরং বহু আগে থেকে সুপরিকল্পিত একটি স্থল অভিযান দিয়েই। ইসরায়েল গোপনে ইরানের মাটিতে একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে বহুদিন ধরেই এই অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, যার মূল চালিকাশক্তি ছিল দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল কেবল প্রযুক্তিনির্ভর আক্রমণের ওপর নির্ভর করেনি, বরং ইরানের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের জন্য গোপনে একটি সুসংগঠিত স্থলভিত্তিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। ইরানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো অনেক আগেই ইসরায়েলি অনুপ্রবেশ ও গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল।
মোসাদ যে এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরানের ভেতরে মোসাদ নিখুঁতভাবে তাদের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করেছিল— যার মধ্যে ছিল দেশটির পরমাণু স্থাপনাগুলো, ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ, কমান্ড সেন্টার এবং কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি।
গোপন অস্ত্র ও যন্ত্রাংশের জোগান দিতে ইসরায়েল জটিল একটি লজিস্টিক অপারেশন পরিচালনা করে, যার মাধ্যমে ইরাকে প্রবেশ করা বাণিজ্যিক কনটেইনার, ট্রাক ও এমনকি স্যুটকেসের ভেতরে ছোট আকারের অস্ত্র, ব্যাটারি, ক্যামেরা, ইঞ্জিন ও গাইডেন্স সিস্টেম ইরানে পাচার করা হয়। এসব উপাদান পরে ইরানের অভ্যন্তরে গোপন কর্মশালায় একত্র করে আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরি করা হতো। থ্রিডি প্রিন্টার ব্যবহার করে তৈরি এই অস্ত্রগুলো অনেক সময় ছিল আত্মঘাতী ড্রোন ও রিমোট কন্ট্রোল ক্ষেপণাস্ত্র। ইরানি বার্তা সংস্থা জানায়, রাজধানী তেহরানে তিনতলা একটি ভবনে আত্মঘাতী ড্রোন তৈরির একটি ঘাঁটির খোঁজ পাওয়া গেছে, যেখানে বিপুল পরিমাণ ড্রোন যন্ত্রাংশ, থ্রিডি প্রিন্টার এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সরঞ্জাম ছিল।
তেহরানে মোসাদ-সংশ্লিষ্ট দুটি পৃথক অভিযান চালিয়ে ইরানি পুলিশ ১৬ জুন দুইজন সন্দেহভাজন এজেন্টকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ২০০ কেজির বেশি বিস্ফোরক, ২৩টি ড্রোন-সম্পর্কিত যন্ত্রাংশ, একটি লঞ্চার এবং একটি গাড়ি। একই সময় ইসফাহান শহর থেকেও বিপুলসংখ্যক মাইক্রো ড্রোন তৈরির উপাদান জব্দ করা হয়।
এই অভিযানে ব্যবহৃত হয় এমন সব অস্ত্র যা আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের প্রমাণ বহন করে। ইরান অভিযোগ করেছে, ইসরায়েলের ব্যবহৃত স্পাইক মিসাইল লঞ্চার ইন্টারনেট-নির্ভর অটোমেশন ও স্যাটেলাইট গাইডেন্স সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ছিল। মোসাদের এজেন্টরা এসব রিমোট কন্ট্রোলড অস্ত্র পরিচালনা করছিল বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এমন অস্ত্র ব্যবহারের ইতিহাস নতুন নয়। ২০২০ সালেও এক ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীকে একইভাবে রিমোট কন্ট্রোল অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যা করা হয়েছিল, যা এ ধরনের অভিযানের পূর্ব-ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরানে এই আক্রমণের প্রথম ধাপ ছিল দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা। এই উদ্দেশ্যে ছোট আকারের আত্মঘাতী ড্রোন, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম এবং ক্ষেপণাস্ত্র একযোগে ব্যবহার করে রাডার ও প্রতিরক্ষা প্ল্যাটফর্মগুলো অকেজো করে ফেলা হয়। একইসঙ্গে ইরানের সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবকাঠামোকে দুর্বল করার লক্ষ্যে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজমি এবং তার ডেপুটির ওপর সরাসরি আঘাত হানা হয়। হামলার পর ইরান সরকার তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে, যা ইঙ্গিত দেয়— দেশটির অভ্যন্তরে নিরাপত্তা ঘাটতি ধরা পড়েছে।
এই গোটা অভিযানের সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিক হলো ইরানের নিরাপত্তা কাঠামোর ভেঙে পড়ার ভয়। সামরিক আক্রমণের পাশাপাশি গোয়েন্দা ও সাইবার অবকাঠামোর ওপরও প্রবল আঘাত এসেছে। সাধারণ মানুষকেও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যদিও ইসরায়েল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার দায় স্বীকার করেনি, তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং ইরানের নিজস্ব বিবৃতিই ইঙ্গিত দেয় যে, এ হামলার প্রস্তুতি বহু বছর ধরে চলছিল। এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং উচ্চ-স্তরের গোয়েন্দা অভিযানের বাস্তবায়ন, যার মাধ্যমে ইরানের অভ্যন্তরে অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। সূত্র: বিবিসি।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ