শিরোনাম
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮:৫২, ২৩ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৩:৩০, ২৩ জুন ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
একই সঙ্গে ইরানজুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র জনরোষ— রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন হাজারো মানুষ। পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের ওপর হামলা এবং সাধারণ নাগরিক নিহত হওয়ায় বিক্ষোভে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
পরিস্থিতি শুধু ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বেই সীমাবদ্ধ নেই; এর প্রভাব পড়ছে বিশ্ববাজারেও— বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দামে লাফ, ডলার-মূল্যের উর্ধ্বগতি এবং শেয়ারবাজারে মন্দার সুর দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা একযোগে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। এই প্রেক্ষাপট শুধু ইরানের জন্য নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্যই একটি নতুন ও জটিল বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শত্রু বড় অপরাধ করেছে: ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়া অব্যাহত থাকবে বলে অঙ্গীকার করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। গত শনিবার (২১ জুন) মধ্যরাতে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। হামলার পর দেওয়া প্রথম বিবৃতিতে খামেনি এ অঙ্গীকার করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে খামেনির এ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। খবর আল–জাজিরার।
এক্স পোস্টে দেওয়া খামেনির ওই বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘জায়নবাদী শত্রু বড় ভুল করেছে, বড় অপরাধ করেছে; এর শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে এবং তারা সেই শাস্তি পাচ্ছে; তারা এখনই শাস্তি পাচ্ছে।’
গত ১৩ জুন ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। পাল্টা হামলা শুরু করে ইরানও। তখন থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে নিজ বাসভবন ছেড়ে বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তিনি সরাসরি যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।
৮৬ বছর বয়সী খামেনির আশঙ্কা, ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র তাকে হত্যা করতে পারে। তেমনটি ঘটলে দ্রুত সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বাছাইয়ের নির্দেশনাও দিয়ে রেখেছেন তিনি। ইরানের আইনসভা, বিচারব্যবস্থা, নির্বাহী বিভাগ এবং সামরিক বাহিনীর সর্বময় ক্ষমতা খামেনির হাতে।
ইরানে বিক্ষোভে ফুঁসছে জনগণ: যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার প্রতিবাদে ইরানে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন। দেশটির রাজধানীজুড়ে রবিবার (২২ জুন) সকাল থেকেই বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়। পরে সেখানে যোগ দেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান।
বিক্ষোভ ‘আমেরিকার আগ্রাসনের জবাব চাই’, ‘আমেরিকা নিপাত যাক’, ‘ইসরায়েল ধ্বংস হোক’- ইত্যাদি নানা স্লোগান দিতে দেখা যায়। প্রতিবাদকারীদের হাতে ছিল ইরানি পতাকা, নিহতদের ছবি এবং ট্রাম্প ও ইসরায়েলি নেতাদের কুশপুতুল। অনেকে হাতে ধরে রেখেছিলেন ব্যানার যাতে লেখা ছিল- ‘আমরা প্রতিরোধ করবো, আত্মসমর্পণ নয়’, ‘হামলা হলে জবাব আসবেই’, ‘পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের রক্ত বৃথা যাবে না’।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই হামলা কেবল ইরানের নয়, সমস্ত মুসলিম বিশ্বের ওপর আঘাত। আমেরিকা জানে না, ইরান কখনো মাথানত করে না।’ ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বিক্ষোভের লাইভ সম্প্রচার করে। অনেক জায়গায় ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থেকে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন প্রতিরোধে সক্রিয় থাকতে।
তেহরানের আজাদি স্কয়ার, ফার্দৌসি স্কয়ার, ইমাম হোমেইনি মসজিদের সামনে এবং পার্লামেন্ট ভবনের সামনে ছিল প্রধান বিক্ষোভস্থল। তবে দেশটির বিভিন্ন স্থানেও ছোটখাটো করে বিক্ষোভ হয়। তেহরানের আজাদি স্কয়ারে আসেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। পরে তিনি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে অংশ নেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিক্ষোভগুলো শুধু সরকার সমর্থিত নয়— বিশেষ করে ইরানে পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের ওপর হামলার পর সাধারণ জনগণের মধ্যেও জাতীয় ঐক্য ও ক্ষোভ উভয়ই দৃশ্যমান।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে সামরিক অভিযানে ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। এর পরই দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ইরানে অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, নিহত ৩: ইরানের মধ্যাঞ্চলে অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় কমপক্ষে তিনজন নিহত হয়েছে। ইরানের সংবাদ সংস্থা ইসনা এ খবর জানিয়েছে। নাজাফাবাদ কাউন্টির গভর্নর হামিদরেজা মোহাম্মদি ফেসহারাকির বরাতে ইসনা বলেছে, অ্যাম্বুলেন্সে একজন রোগীকে অন্য হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। ড্রোন হামলায় অ্যাম্বুলেন্সটি অনেকটাই ভেঙেচুরে গেছে।
ফেসহারাকি আরো বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে থাকা চালক, রোগী ও রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজন নিহত হয়েছেন। ড্রোন হামলার পর অ্যাম্বুলেন্সটির চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আরেকটি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খায়।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গত শনিবার সন্ধ্যায় হামলার পরের দিন রবিবার রাতেই যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে তেলের ফিউচার দাম বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য তিন দশমিক ছয় শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি ব্যারেলের দাম দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ৪৭ ডলার। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে পরিচিত ব্রেন্ট তেলের দাম তিন দশমিক দুই শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৪ দশমিক ৫৯ ডলার।
তবে, শেয়ারবাজারে সার্বিকভাবে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। ডাও ফিউচারস সূচক ২৫০ পয়েন্ট বা শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ কমেছে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচারস এবং নাসডাক ফিউচারস— উভয় সূচকই প্রায় শূন্য দশমিক ছয় থেকে শূন্য দশমিক সাত শতাংশ কমেছে।
এদিকে বিশ্ববাজারে এই অস্থিরতার মধ্যেই মার্কিন ডলারের মান বেড়েছে প্রায় শূন্য দশমিক তিন শতাংশ। বৈশ্বিক সংকট ও অনিশ্চয়তার সময়ে ডলারের মান সাধারণভাবে বৃদ্ধি পায়। তবে, ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে এই প্রবণতা এবার কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে নতুন মাত্রা ও মার্কিন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় বাজারে উদ্বেগ বাড়ছে, যার প্রভাব সরাসরি জ্বালানি ও বিনিয়োগ খাতে পড়ছে। রবিবার বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ হরমুজ প্রণালি বন্ধের অনুমোদন দিয়েছে ইরানের পার্লামেন্ট। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ। এই প্রণালি বন্ধ থাকলে বিশ্ববাজারে তার বড় প্রভাব পড়বে। বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রণালি দিয়েই পরিবহন করা হয়।
ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া যাবে না: যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টেলিফোনে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ডাউনিং স্ট্রিট জানিয়েছে, লন্ডনের স্থানীয় সময় রবিবার সন্ধ্যায় হওয়া এই ফোনালাপে দুই নেতা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য ‘গম্ভীর হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়েও তারা আলোচনা করেছেন। স্টারমার ও ট্রাম্প মনে করেন, এই হামলা ইরান থেকে আসা হুমকি কমানোর একটি প্রচেষ্টা।
ডাউনিং স্ট্রিটের বিবৃতির বরাতে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া যাবে না, এই বিষয়ে তারা একমত। এই দুই নেতা বলেন, আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে ইরানের যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার টেবিলে ফিরে আসা প্রয়োজন। তারা ভবিষ্যতেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ