ঢাকা, শুক্রবার, ০৮ আগস্ট ২০২৫

২৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৩ সফর ১৪৪৭

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর

সংস্কার, স্থিতিশীলতা ও নির্বাচনের প্রস্তুতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১:৫১, ৮ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১২:৫১, ৮ আগস্ট ২০২৫

সংস্কার, স্থিতিশীলতা ও নির্বাচনের প্রস্তুতি

ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আজ, ৮ আগস্ট, তাদের এক বছর পূর্ণ করল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দীর্ঘ ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের পর, তিন দিন পর ৮ আগস্ট নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু হয়।

গণঅভ্যুত্থানে নিহত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের রক্তে লেখা জুলাইয়ের শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার শুরু থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে রয়েছে—নির্বাচনী ব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা এবং অভ্যুত্থানে নিহতদের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া।

গত ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে গণজাগরণ চূড়ান্ত বিজয় লাভের দিনে, ‘গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে সরকার জাতির সামনে জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করে। একইসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিক দফায় সংলাপের পর জুলাই সনদ চূড়ান্তকরণের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বড় রাজনৈতিক ঘোষণা আসে গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মুখে—২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি জানান, নির্বাচন রমজান শুরুর আগেই সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানানো হবে। পরদিন, ৬ আগস্ট, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি পাঠানো হয়, যাতে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, এই চিঠির মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের অনুরোধ প্রক্রিয়াগতভাবে সম্পন্ন হলো। এরপর ৭ আগস্ট রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের জানান—সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে ঘোষণা করা হবে।

এক বছরের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচারব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকার সংস্কার কমিশন এবং নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। অধিকাংশ কমিশন ইতোমধ্যেই তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকার সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন শুরু করেছে।

অর্থনীতিতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের ফলে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা দিয়েছে। ২০২৫ সালের জুনে দেশে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৮.৪৮ শতাংশে—যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জানান, ডিসেম্বরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। তিনি স্বীকার করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই ছিল এই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনে। এতে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও, সরকারের তৎপর পদক্ষেপ, বাজার মনিটরিং এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণের ফলে তা রোধ করা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে এবারের রমজান থেকে বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।

অর্থনীতির আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো প্রবাসী আয়ে রেকর্ড প্রবাহ। সরকারের প্রতি আস্থায় প্রবাসীরা গত অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ৩ হাজার ৩৩ কোটি মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন—যা রপ্তানি আয় প্রায় নয় শতাংশ বাড়িয়েছে এবং টাকার মান শক্তিশালী করেছে। বহু বছর পর ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা আরো জানান, গত ১১ মাসে বিদেশি ঋণদাতাদের কাছে ৪ বিলিয়ন ডলার সুদ ও মূলধন পরিশোধ করা হয়েছে—যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবুও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই বাড়ছে।

এক বছরে সরকার রাজনৈতিক সংস্কার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নির্বাচনী প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি দেখিয়েছে, তাতে দেশে একটি দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/ইউকে

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন